শিউলিমালা একাডেমি

বি আম্মা: ভারতীয় মুসলিম নারীদের এক পথিকৃৎ


আবাদি বানু বেগম, একজন মুসলিম নারী, যিনি এই উপমহাদেশের সচেতন নারীদের বিশেষত, মুসলিম নারীদের জন্য এক উজ্জ্বল উপমা। তিনি এমন একজন নারী, যিনি ছিলেন খেলাফত আন্দোলন এবং ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের একজন নেত্রী। যদিও, আরও অনেক ব্রিটিশ বিরোধী মুসলিম মহানায়কদের মতো তার ইতিহাসও আমাদের থেকে আড়ালেই রাখা হয়েছে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নারীকর্মী হিসেবে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এ উপমহাদেশে অনেক আলোচিত হলেও আবাদি বানু বেগম খুবই অনালোচিত। এদেশের খুব কম মানুষই তার নাম জানে।

আবাদি বানু বেগম, ‘বি আম্মা’ হিসেবেই অধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি সরোজিনী নাইড়ু, কমলা দেবী চট্টোপাধ্যায়, আন্নি বেসান্তের মতো ব্রিটিশ বিরোধী কর্মীদের সমসাময়িক। তিনি ১৮৫০ সালে ভারতের রামপুরের একটি দেশপ্রেমিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবেই তিনি ১৮৫৭ সালে সংগঠিত হওয়া সিপাহি বিদ্রোহ দেখেন। বুঝতে শুরু করেন উপনিবেশিক শাসনের ভয়াবহতা। চোখে দেখা এই বিদ্রোহই হয়তো ছিল তার আমৃত্যু লালিত স্বাধীন দেশের আকাঙ্ক্ষার উৎস।

অল্প বয়সেই ‘বি আম্মা’ বিধবা হন। স্বামীর ইন্তিকালের পর একাই দুই সন্তানকে মানুষ করার জিম্মা নিজ কাঁধে তুলে নেন। তার সেই দুই ছেলেই পরবর্তীতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের স্মরণীয় ও লড়াকু ব্যক্তিত্ব মোহাম্মদ আলী জওহর এবং শওকত আলী।

রাজমোহন গান্ধী তার লিখিত বই Eight Lives: a Study of the Hindu-Muslim Encounter- এ বর্ণনা করেছেন কীভাবে এই বিধবা তরুণী নিজ সন্তানদের অনাড়ম্বর এবং রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর সুন্নাত এর উপর জীবন গড়ে তুলেছেন। বিচক্ষণ, দূরদর্শী এই নারী তার সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করান। যেসময় বেশিরভাগ মুসলিমই ইংরেজি শিক্ষাকে বর্জন করেছিল, সে সময় আবাদি বানু বুঝতে পেরেছিলেন, ইংরেজি শিক্ষা ব্যতীত তৎকালীন সমাজে মুসলিমদের অবস্থান পুনরুদ্ধার সম্ভব না।

সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করানোর কারণে সন্তানদের চাচা অর্থ প্রেরণ করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন এটা মনে করে যে, এতে করে তার ভাতিজারা কাফের হয়ে যাবে। কিন্তু তাতে দমে যাননি এ বিধবা নারী। নিজেই নিজের অলংকার বন্ধক রেখে সন্তানের পড়াশোনার অর্থ জোগান।

‘বি আম্মা’ খেলাফত আন্দোলন এবং ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্যও অর্থ সংগ্রহ করেন। যখন তার দুই ছেলেকে ব্রিটিশ বিরোধিতার জেরে জেলে যেতে হয় তখন ‘বি আম্মা’ সন্তানদের হয়ে বক্তৃতা দেন। তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশে এটাই ছিল প্রথম কোনো মুসলিম নারীর বোরকাবৃত হয়ে রাজনৈতিক কাজে সরাসরি অংশগ্রহণ। এমনকি নিজ দুই পুত্র এবং আন্নি বেসান্তকে জেল জীবন থেকে মুক্ত করতে আবাদি বানু ১৯১৭ সালের সত্যাগ্রহ আন্দোলনেও অংশ নিয়েছিলেন। তার স্পৃহা দেখে মহাত্মা গান্ধী তাকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন যেন তিনি তদানীন্তন উপমহাদেশের নারীদের ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে সমর্থন আদায়ে কাজ করে যান। পরবর্তীতে ‘বি আম্মা’ খিলাফাত আন্দোলনে নিজে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন এবং অন্যান্য নারীদেরও উৎসাহিত করেন।

খিলাফাত আন্দোলনের সময় ‘বি আম্মা’ শুধু যে অর্থ উত্তোলনের মাঝেই নিজের কাজকে সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন এমন নয়। বরং তিনি নারীদের সভায় একত্রিত করে ধর্মীয়, রাজনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থা বুঝানোর চেষ্টা করতেন। তাদেরকে দেখানোর চেষ্টা করতেন কেন তাদের বিদেশি পণ্য বয়কট করা উচিত এবং এর প্রভাব কী হতে পারে।

সেসময় অনেকেই সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের বেশভূষা ধারণ করতেন। তাদের সংস্কৃতিকে লালন করতেন। এমন দৃশ্য অন্যান্য চিন্তাশীল ভারতীয় মুসলিমদের মতো ‘বি আম্মা’কেও পীড়িত করে তুলেছিল। তাই তিনি দৃপ্ত কণ্ঠে সতর্ক করে বলেন, “বিদেশিদের জীবনাচার পরিত্যাগ করো। নিজ পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য ধরে রাখ। এই বিদেশিদের জন্য কাজ করো না, আর তাদের থেকে সম্মান- মর্যাদার প্রত্যাশা করো না। কেননা এরা ধূর্ত প্রকৃতির এবং অসৎ।”

আরেক জনসভায় তিনি বলেছিলেন,
“বিগত দেড়শো বছর যাবত ভারতীয়রা দুটো ভুল করে যাচ্ছে। প্রথমত, একশ্রেণির লোকেরা শুরু থেকে ব্রিটিশদের পক্ষাবলম্বন করা শুরু করে যার ফলে এক পর্যায়ে গিয়ে রাজত্ব ব্রিটিশদের হাতে চলে যায়। দ্বিতীয়ত, ‘৫৭ এর সিপাহি বিদ্রোহর সময় তারা ঔপনিবেশিকদের দোসর হিসেবে কাজ করে। যদি ভারতীয়রা সেই সময় এই ভুলগুলো না করত তবে কখনোই ইংরেজ বেনিয়ারা আমাদের পরাধীনতার শৃঙ্খলবেড়ি পরাতে পারত না। এখন, দায়িত্ব একটাই- স্বাধীন মানুষের ন্যায় নিজ লক্ষ্যের উপর অটুট থেকে কাজ চালিয়ে যাওয়া।”

অসহযোগ আন্দোলনের সময় তিনি বলেছিলেন,
“যা হবার তাতো হবেই,
জুলুম করতে করতে জালিম নিজেই ক্লান্ত হয়ে যাবে।”

‘বি আম্মা’ তার বক্তৃতার মাধ্যমে হিন্দু – মুসলিমদের মাঝে একতা জাগিয়ে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন। যা তাদেরকে অভিন্ন শত্রু সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশদের বিরুদ্ধে এক কাতারে দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
সাধারণ মানুষের ভিতর এই ঔপনিবেশিক শাসনের ভয়াবহতা তুলে ধরা এতটা সহজ ছিল না। এর জন্য তাকে সফর করতে হয়েছে বহু এলাকা, পাড়ি দিতে হয়েছে বহু পথ।


১৯২২ সালের বিহার সফরকালে তিনি পথিমধ্যে আরও বিভিন্ন এলাকা যেমন আরাহ, গয়া, মুঙ্গির, এবং পাটনার জনসভায় অংশ নিয়েছিলেন। সেসব সভায় মাযহারুল হক, ড. মাহমুদ, আব্দুল হাকিম ওয়াকিলের মতো ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন।

‘বি আম্মা’ ছিলেন প্রচণ্ড আত্মমর্যাদাবান নারী। কোনো কিছুই তার মাথা নোয়াতে পারেনি। একবার এমন একটা গুজব রটে যে, মোহাম্মদ আলীকে কারাবাস থেকে মুক্তি দেয়া হবে যদি মোহাম্মদ আলী ব্রিটিশদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। ছেলেকে কাছে পাবার ইচ্ছা ‘বি আম্মা’ কে তার নৈতিক অবস্থান থেকে বিন্দুমাত্র টলাতে পারেনি। গুজবটা যখন তার কানে পৌঁছে তখন তিনি বলেন, “মোহাম্মদ আলী ব্রিটিশদের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাওয়া তো দূরের কথা, এটা কল্পনাও করতে পারে না। তবে যদি সে ক্ষমা চায়-ই তাহলে আমার বয়সের ভারে দুর্বল হয়ে যাওয়া হাতগুলোই তার টুটি চেপে ধরার জন্য যথেষ্ট।”

একটা সময় গিয়ে আবাদি বানু তার পুত্র মাওলানা মোহাম্মদ আলীকে উচ্চারিত শব্দগুছ স্ফুলিঙ্গের ন্যায় ছড়িয়ে পড়ে মানুষের মুখে মুখে।

“বোলে আম্মা মোহাম্মদ আলী সে,
জান বেটা খিলাফাত প্যায় দে দো।”

(আম্মা মোহাম্মদ আলীকে বলেন,
তোমার জীবন খিলাফতের জন্য দিয়ে দাও)

রাখহারি চ্যাটার্জির তার রচিত বই Gandhi and the Ali Brothers: Biography of a Friendship- তে মাওলানা মোহাম্মদ জওহর ‘বি আম্মা’কে নিয়ে বলতে গিয়ে বলেন, “যদিও ‘বি আম্মা’র প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না তবে ওনার প্রজ্ঞা ও বিচারবুদ্ধি এমন ছিল যে আমি আমার জীবনে অন্য কোনো নারী কি, পুরুষকেও এতটা সুবিবেচক পাইনি।”

আবাদি বানু আধুনিক শিক্ষার গুরুত্বকে অস্বীকার করেননি আর না ছেড়ে দিয়েছিলেন নিজ দ্বীন এবং সংস্কৃতিকে। তিনি পরিপূর্ণ পর্দার ভিতরে থেকেই জীবন যাপন করে গেছেন কিন্তু তাই বলে প্রয়োজনীয় কাজগুলো করা থেকে নিজেকে অব্যাহতি দেননি।

প্রখ্যাত ভারতীয় সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার বলেন, “এটা খুবই দুঃখজনক যে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় ‘বি আম্মা’র অবদানকে মূল্যায়ন করা হয় না। এটা সময়ের দাবী যে তার অবদান তুলে ধরা এবং আমাদের স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তার কর্মময় জীবনের উপর লিখিত বই পড়ানো।”

বি আম্মা মানুষের হৃদয়ে সৃষ্টি করেছিলেন সাহস এবং জাগিয়েছিলেন এক স্বাধীন ভূখণ্ডের আশা। ১৯২৪ সালে এই মহীয়সী ক্ষণস্থায়ী পৃথিবী ত্যাগ করেন। রেখে যান তার দেখানো পথ, স্পৃহা এবং একটি সম্প্রীতিপূর্ণ সমাজের স্বপ্ন।

সংকলক: নাদিরাতুর রহমান

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *