শিউলিমালা একাডেমি

নাসির-উল-মুলক মসজিদ : রঙের এক অপূর্ব সমন্বয়

দক্ষিণ ইরানের সর্বাধিক সুন্দর স্থাপত্যের এক অনুপম নমুনা নাসির-উল-মুলক মসজিদ। এর প্রতিটি কোণ, প্রতিটি অংশ যেন শিল্পীর নিখুঁত আচড়ে আঁকা! ইরানের ঐতিহ্যবাহী শহর শিরাজের সবচেয়ে দর্শনীয় স্থাপনা এটি। দাগকাটা কাচের জানালার জন্য সৃষ্ট রঙিন আলোর কারণেই মসজিদটি সবার কাছে এত সমাদৃত।

দক্ষিণ ইরানের সবচেয়ে সুন্দর শহরের একটি হলো ‘শিরাজ’। অসংখ্য পর্যটক প্রতিবছর এখানে বেড়াতে আসেন। প্রাচীন পারস্যের অন্যতম পুরনো শহর এটি। এই শহরকে কবি, সাহিত্য, ফুল এবং বাগানের শহর নামেও অভিহিত করা হয়। ইরানের প্রধান পর্যটনকেন্দ্রের মধ্যে এটি একটি এবং সেইসাথে এই শহরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বৈশ্বিকভাবে বেশ গুরুত্বের দাবিদার। ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে ‘শিরাজ’ বরাবরই পর্যটকদের দৃষ্টি কেড়েছে। এর মাঝে অন্যতম একটি স্থাপনা হলো নাসির-উল-মুলক মসজিদ।

কাজার রাজবংশের শাসনামলে উনিশ শতাব্দীর শেষদিকে এই মসজিদ তৈরি হয়। এটি ইরানের অনন্য এক স্থাপনা। মসজিদটি তার বর্ণিল কাচ এবং অভিনব টাইলসের জন্য বিখ্যাত।

মসজিদটি বিভিন্ন জনের কাছে বিভিন্ন নামে পরিচিত। অধিকাংশ মানুষ একে ‘গোলাপী মসজিদ’ নামে চেনেন। এর কারণ হলো – মসজিদের টাইলসগুলো অদ্ভুত সুন্দর গোলাপের রঙে রাঙানো। এছাড়াও এটি ‘বর্ণিল মসজিদ’, ‘রঙধনু মসজিদ’ এবং ‘ক্যালিডাইস্কোপ’ বা ‘বিচিত্রদৃক’ মসজিদ নামেও পরিচিত।

লতিফ আলী খান রাস্তার দক্ষিণ অংশে এটি অবস্থিত। কাজার শাসক মীর্জা হাসান আলী নাসির উল মুলকের নির্দেশে এই মসজিদ নির্মাণ করা হয়। ইরানী স্থাপত্যবিদ মোহাম্মদ হাসান-ই-মিমার এবং মোহাম্মদ রেজা কাশীসাজ এর নকশা প্রণয়ন করেন। চমৎকার এই মসজিদটির নির্মাণকাজ শেষ হতে সময় লেগেছিল প্রায় ১২ বছর।

২৮৯০ বর্গমিটারের এই মসজিদটি নির্মাণকাজের দিক দিয়ে, বিশেষত টাইলস ও মুকারনাসের (ইসলামী স্থাপত্যে আলংকারিক ব্যবহার) ক্ষেত্রে এটি ইরানের সবচেয়ে মূল্যবান মসজিদ। এর দুটি শাবিস্থান (ভূগর্ভস্থ একটি স্থান যা সচরাচর ইরানের প্রাচীন মসজিদ, বাড়ি এবং বিদ্যালয়গুলোতে দেখা যায়। সাধারণত গ্রীষ্মকালে এটি ব্যবহৃত হতো) রয়েছে। একটি পূর্বদিকে এবং অন্যটি পশ্চিমে।

পূর্বদিকের শাবিস্তানে জায়গার মাঝ বরাবর সারিবদ্ধভাবে সাতটি স্তম্ভ রয়েছে। মসজিদের সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর অংশ হলো পশ্চিম শাবিস্তান। সেখানে দুই সারিতে ছয়টি করে মোট বারটি স্তম্ভ বিদ্যমান। সপ্তম স্তম্ভটি দুইটি খুঁটির মাঝে অবস্থিত। একদম শেষ প্রান্তে চমৎকার টালি দিয়ে সাজানো একটি মঞ্চ রয়েছে। মঞ্চের মেঝেটি মার্বেল পাথর দিয়ে তৈরি এবং এর উপরের অংশ শাবিস্তানের চেয়ে নিচুতে অবস্থিত। পশ্চিম শাবিস্তানে বর্ণিল কাচে সজ্জিত সাতটি কাঠের দরজা দন্ডায়মান। দরজাগুলোর মাধ্যমে বাইরের আঙিনায় বেরিয়ে আসা যায়।

উজ্জ্বল নকশার কাচ, ছাদের দেয়ালে হাজারো রঙিন টালি এবং মেঝেতে পারস্যের ঐতিহ্যবাহী কার্পেট যেন প্রতিটি কোণা থেকে এই প্রার্থনার স্থানে সৃষ্টি করেছে এক অনুপম রঙধনু। এই রঙের মেলায় পুরো মসজিদকে যেন একটি ক্যালিডাইস্কোপের (যার মাঝে অসংখ্য রঙের খেলা দেখা যায়) মতো মনে হয়।
মসজিদের ঠিক কেন্দ্রে একটি খোলা চত্বর বিদ্যমান। অসংখ্য ফুলে পরিবেষ্টিত এই চত্বরে একটি আয়তাকার জলাশয়ও রয়েছে।

বিল্ডিংয়ের সামনের অংশে (বহির্ভাগে) ডজনখানেক খিলান যেন এই কাচময় আলোক রাজ্যের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। অন্যান্য মসজিদের মতো নাসির-উল-মুলক মসজিদে কোনো গম্বুজ নেই। এটি নির্দেশ করে যে এই ধর্মীয় স্থাপনাটি ব্যক্তি বিশেষের জন্য নির্দিষ্ট ছিল, জনসাধারণের জন্য নয়। ভিন্ন রকমের টাইলসের ব্যবহার মসজিদটিকে দান করেছে অনন্যতা। সেইসাথে এখানে ব্যবহৃত গোলাপী রঙও বেশ দৃষ্টি কাড়ে, যা গোটা ইরানে বিরল।

শরৎ এবং শীতকালে যখন কাচের গায়ে সূর্যের আলো পড়ে নীল মোজাইকে প্রতিফলিত হয়, তখন যে দৃশ্যের উদ্ভব ঘটে তা বর্ণনা করার ভাষা নেই৷ মসজিদের এই নান্দনিক সৌন্দর্য-ই এটিকে ইরানের অন্যান্য মসজিদ থেকে করেছে আলাদা। সম্প্রতি, নাসির-উল-মুলক মসজিদকে রাতেও আলোকিত করা হয়েছে যাতে বর্ণিল কাচের মধ্য দিয়ে আলো অতিক্রমের মাধ্যমে পুরো মসজিদ এক অনুপম সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত হতে পারে। এখনো এই মসজিদটি প্রার্থনাকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ১৯৫৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে মসজিদটি ইরানের জাতীয় ঐতিহ্য হিসেবে নথিভুক্ত হয়, যার রেজিস্ট্রেশন নাম্বার ৩৬৯।

নাসির-উল-মুলক মসজিদ ভ্রমণের শ্রেষ্ঠ সময় হলো সকাল নয়টার পূর্বে। এই সময়ই পুরো হলঘরে কার্পেট এবং কাচের মধ্যে আলোর খেলা চলে, যার সৌন্দর্য অতুলনীয়!

সংকলক : তাহারাতুন তাইয়্যেবা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *