শিউলিমালা একাডেমি

সভ্যতার ঝাণ্ডা বুলন্দকারী বীর মহান সুলতান আওরঙ্গজেব আলমগীর


ইতিহাস বৃক্ষের শিকড়ের মতো। যে জাতির ইতিহাস যত প্রাচীন, সে জাতি তত বেশি সমৃদ্ধ। এদিক থেকে বিচার করলে ভারতবর্ষের অধিবাসীরা নিঃসন্দেহে সমৃদ্ধ জাতি। ১৫২৬ থেকে ১৭০৭ সাল পর্যন্ত স্থায়ী মুঘল শাসনামল এক সোনালী ইতিহাসের সোনালী শৃঙ্খল, গৌরবময় ইতিহাসের আরেকটি যুগ। এ যুগের শাসকদের মধ্যে একজন হলেন অসামান্য বীরত্ব, সাহসিকতা ও উচ্চ মননশীল হৃদয়ের অধিকারী সুলতান আওরঙ্গজেব আলমগীর, যাঁর শাসন ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায়ের সূচনা করে যা পরবর্তী যুগের ভারতবর্ষকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।

সুলতান আওরঙ্গজেব জ্ঞানী-গুণী সুলতানদের অন্যতম ছিলেন। তিনি শুধু একজন ধার্মিক ও ন্যায়পরায়ণ শাসকই ছিলেন না, বরং একজন মুসলমানের যতটা শিক্ষা লাভ কর উচিত, ততটা শিক্ষাই তিনি সুচারুভাবে লাভ করেছিলেন। তিনি ছিলেন বহু ভাষাবিদ। একই সাথে আরবি, ফার্সি, উর্দু, তুর্কি, হিন্দি ভাষায় তার পাণ্ডিত্য ছিলো। শুধু তাই নয়, তিনি বিভিন্ন বিষয়ে, যেমনঃ ইতিহাস, ভূগোল, গণিত, চিকিৎসাবিদ্যা, ইসলামী তত্ত্বজ্ঞান ও জ্যোতির্বিদ্যায় গভীর জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। তাঁর ইতিহাস প্রকৃতপক্ষে ভারতবর্ষেরই ৬০ বছরের ইতিহাস। সপ্তাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধব্যাপী তাঁর শাসনামল (১৬৫৮-১৭০৭ সাল) ভারতবর্ষের ইতিহাসের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তাঁর অধীনেই মুঘল সাম্রাজ্য সবচেয়ে বেশি বিস্তৃতি লাভ করেছিলো। তাঁর শাসনামলই ছিলো ভারতবর্ষে ইসলামের সর্বশেষ অগ্রযাত্রার ফসল। এ বিশাল সালতানাত গড়ে উঠেছিলো একক রাজনৈতিক ব্যবস্থার অধীনে। তাঁর সময়েই ১৭০০ সালে চীনকে পেছনে ফেলে ভারতবর্ষ পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম অর্থনৈতিক অঞ্চলে পরিণত হয়। তাই এ সম্রাটকে আলেমগণ সম্বোধন করেছেন ‘আমিরুল মুমিনিন’ বা বিশ্বাসীদের নেতা হিসেবে এবং শাসক হিসেবে তুলনা করেছেন উমর (রা.) ও সালাউদ্দিন আইয়ুবির সাথে। তাঁকে মুঘল সালতানাতের শেষ সফল সুলতানও বলা হয়। তিনি একাধারে একজন হাফেজ, বহু ভাষায় পন্ডিত, দক্ষ সেনাপতি, অনেক বড় মাপের সুফি এবং আলেম ছিলেন। তিনি ভারতীয় উপমহাদেশ শাসন করেছিলেন শরিয়াহ আইন ও ইসলামী অর্থনীতির মাধ্যমে। একজন ধর্মপ্রাণ সুন্নি মুসলমান হিসেবে সুলতান তাঁর শাসনকার্য পরিচালনায় কোরআন এর নীতিকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন। তিনি শাসনকার্য পরিচালনায় নানা ধরনের গর্হিত কাজকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন যা পরবর্তীতে তাঁকে সমালোচনার পাত্র হিসেবে বিশ্ববাসীর সামনে দাঁড় করায়। তাঁর উদ্যোগেই আইন সংক্রান্ত নিয়ম-নীতিসমূহের এক ব্যাপক সংকলন ‘ফতোয়া-ই-আলমগীরী’ প্রণীত করা হয়।

তাঁর শাসনামলে জিডিপি ছিল সে সময়ের সমগ্র বিশ্বের ৪ ভাগের ১ভাগ। তিনি তাঁর পূর্ববর্তী তিন সুলতানের নীতি অনুসরণ করে ইসলামকে প্রভাবশালী ধর্মীয় শক্তি হিসেবে ব্যবহার করতে সচেষ্ট ছিলেন। তাঁর এ চেষ্টা অপরাপর শক্তিগুলোর সাথে তাঁকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দিয়েছিলো। ঐতিহাসিক ক্যাথরিন ব্রাউন এর মতে, “আওরঙ্গজেব নামটি এমন ছিলো যে, প্রকৃত ইতিহাসকে বিবেচনায় না নিয়ে তাকে একজন ধর্মীয় গোঁড়ামি ভিত্তিক রাজনীতিক হিসেবে কল্পনা করতে উদ্বুদ্ধ করে।”
কিন্তু শাসনকার্য তাঁর ভূমিকা ছিলো অপরিসীম। শিল্প ও সংস্কৃতিতেও তাঁর অনন্য ভূমিকা ছিলো। স্থাপত্যকর্মের উন্নতিতেও ছিলো তার উল্লেখযোগ্য অবদান। তিনি দিল্লির লাল কেল্লার ভিতরে ‘মোতি মসজিদ’ নামক একটি মার্বেল পাথরের মসজিদ তৈরি করেন, লাহোরে ‘বাদশাহী মসজিদ’ নির্মাণ করার নির্দেশ দেন, এমনকি বেনারস ও শ্রীনগরে যে মসজিদটি নির্মাণ করেন, তা আজও কাশ্মীরে সবচেয়ে বড় মসজিদ হিসেবে পরিচিত। তিনি বস্ত্র শিল্পেরও প্রসার‌ ঘটিয়েছিলেন, যা অন্যান্য সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করেছিলো। তাঁর হাত ধরেই দাক্ষিণাত্য প্রশাসনের উন্নতি সাধিত হয়।

সুলতান আওরঙ্গজেব এর শাসনকাল ২ ভাগে বিভক্ত ছিলো, যার প্রতিটির স্থায়িত্বকাল ছিলত ২৫ বছর করে। ১ম ভাগ তিনি উত্তর ভারতে কাটিয়েছেন আর ২য় ভাগ কাটিয়েছেন দাক্ষিণাত্যে। শাসনকালের দ্বিতীয়ার্ধে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে যায়, সাম্রাজ্যের সবকিছু যেন দাক্ষিণাত্যে কেন্দ্রীভূত হতে শুরু করে। যে শাসনকাল ব্রিটিশ-পূর্ববর্তী সর্ববৃহৎ ভারতীয় সাম্রাজ্যের উত্থান দেখেছিলো, সেটিই আবার দেখছিলো তার পতনের চিহ্ন। যে শাসনকালে মুঘল সালতানাতের ভাগ্যাকাশ হয়েছিলো পূর্ণ প্রস্ফুটিত, তার পরই শুরু হয়েছিলো ক্ষয়। যে শাসনকালে আমাদের রাজনীতির আকাশে ফুটে উঠেছিলো এক নতুন আলোর আভাস, তার পর থেকেই শাসনকার্যে শুরু হতে থাকে একের পর এক যুদ্ধ-বিগ্রহ। আওরঙ্গজেব ধারাবাহিকভাবে কিছু অভিযান পরিচালনা করেন। এ সময়ে অনেক ছোট ছোট অভিযান চালানো হয়েছে সুদূরের বিচ্ছিন্ন জেলাগুলোর আইন ভঙ্গকারী চাষী আর গোত্রপ্রধানদের বিরুদ্ধে। এ সময়েই মারাঠা জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটেছিলো। শিখ সম্প্রদায়ও মাথাচাড়া দিয়েছিলো। তখন সুলতানের অসহিষ্ণুতা চরমে উঠে। তিনি শাসনকালের ২য় বছরের শুরু থেকে রাজধানী থেকেই রাষ্ট্র পরিচালনা করতেন। পরবর্তী ২বছর কাটান রাজপুতনায়, আর শাসনকালের ২৫তম বছরের শুরুতে তিনি রওনা দেন দাক্ষিণাত্যে, সেখানেই তাঁর জীবন ও শাসনকালের সমাপ্তি ঘটে।

তাঁর সম্পর্কে দ্বিপক্ষিক অভিমত রয়েছে। একপক্ষের অভিমত হলো তিনি ছিলেন শ্রেষ্ঠতম, নিষ্ঠাবান, ধার্মিক, হাফেজ, আলেম, পণ্ডিত, দূরদর্শী, সংযমী ও ন্যায়বান শাসক। অনেকে তাঁকে বলতেন ‘জিন্দাপীর’। অপরপক্ষের মতে তিনি ছিলেন গোঁড়া মুসলমান, হিন্দুবিদ্বেষী, অত্যাচারী, জিজিয়া কর আদায়কারী, হিন্দু মন্দির অপবিত্রকারী ও ধ্বংসকারী বাদশাহ। দ্বিতীয় পক্ষের মতের নিদর্শনসমূহের সন্ধান শুধু ভারতবর্ষের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসেই পাওয়া যায়। আমরা অনেকেও আমাদের মননে মস্তিষ্কে এটিই লালন করে থাকি। ভারতবর্ষের কোমলমতি ছাত্রদের মনে ধারণা দেয়া হয় যে, সুলতান আওরঙ্গজেব ধর্মপরায়ণ কিন্তু হিন্দুবিদ্বেষী, তিনি তাদের উপর জিজিয়া কর চাপিয়ে দিয়েছিলেন, পিতাকে বন্দী করে রেখেছিলেন, ভাইদের হত্যা করে সিংহাসনে বসেছিলেন, জোরপূর্বক হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করেছিলেন; অপরপক্ষে‌ সম্রাট আকবর হিন্দু-মুসলিম সমান চোখে দেখতেন। এ সকল তথ্য অবগত হওয়ার পর যতই সত্য ইতিহাস সামনে আসুক না কেনো, পূর্বেকার ইতিহাস পাঠের প্রভাব কাটিয়ে উঠা যে কত কঠিন হয়ে যায়, তা চিন্তাশীল পাঠক-পাঠিকাদেরকে আর বিশদভাবে বলার প্রয়োজন পড়ে না। অথচ একটু চিন্তা করলেই আমরা দেখতে পাই, সুলতান মোটেই এ চরিত্রের মানুষ ছিলেন না, বরং সুলতান হিসেবে তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপ যে যুক্তিসংগত কারণ ও জনকল্যাণার্থে নেওয়া হয়েছিলো, গবেষণার মাধ্যমে অনেক হিন্দু ইতিহাসবিদগণও তার প্রমাণ পেয়ে তাদের পুস্তকে লিখে রেখে গিয়েছেন। তাঁর সুশাসন ও বিজ্ঞোচিত পদক্ষেপের কারণে তিনি তাঁর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত দীর্ঘ ৫০ বছর বিশাল হিন্দুস্থান নিজ সুশাসনে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর শাসনকালকে ন্যায়বিচারের কাল বলা হয় বিশেষভাবে।

অনেক ইতিহাসবিদ সুলতানকে হিন্দুবিদ্বেষী বলে চিহ্নিত করে থাকেন। অথচ তিনি ভিন্ন ধর্মের ও মতাদর্শের প্রতি যথেষ্ট উদার, মহৎ ও সহনশীল ছিলেন। তিনি যদি অত্যাচারী শাসক হতেন, তাহলে কি দীর্ঘ ৫০ বছর রাজত্বের পর ভারতে হিন্দুদের অস্তিত্ব থাকার কথা! অতএব, সুলতানের প্রতি সকল অভিযোগের মীমাংসায় পৌঁছতে হলে প্রতিটি বিষয়ে সমীক্ষা চালানো ও চুলচেরা বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।

সুলতান আওরঙ্গজেব এর অর্থনীতি, শাসননীতি এত সুন্দর ও প্রখর ছিলো যে, মনীষী কার্ল মার্ক্সও মুঘল ইতিহাসের এ অধ্যায়কে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পাঠ করেছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন, সুলতানের রাজত্বের যত বৈশিষ্ট্য, তার সবই ইসলাম ধর্ম তথা কোরআন-হাদিসের উপর ভিত্তি করে গঠিত হয়েছিলো। এর সাথে তিনি আরও উপলব্ধি করেছিলেন যে, মুসলিম বাদশাহগণের মধ্যে যারাই অন্যায় করেছেন, তারা কোরআনের নীতি থেকে ততই দূরে ছিলেন বলেই তা করেছিলেন। সুলতান আওরঙ্গজেব তাঁর শাসনামলের পুরো সময় জুড়েই ছোট-বড় অনেক বিদ্রোহ দমন ও অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। এভাবেই শাসনকালের শেষ সময়ে এসে মৃত্যুর কোলে ঢেলে পড়েন আওরঙ্গজেব। খুবই অসুস্থতার ভিতর দিয়ে কাটে তাঁর শেষ সময়কাল। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর মৃত্যু যেন জুমার দিনে হয়। অবশেষে আল্লাহ তাঁর ডাকে সাড়া দেন। ১৭০৭ সালের ৩রা মার্চ, আহমদাবাদে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

উপমহাদেশের ইতিহাসে ইসলামী সভ্যতাকে একটি সার্বজনীন প্রেক্ষাপটে আনয়নকারী শক্তি ছিলো মুঘল সালতানাত। ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা ও তৎকালীন বিশ্বের সর্ববৃহৎ শক্তিশালী অর্থনীতির মাধ্যমে তারা গোটা উপমহাদেশকে সাজিয়ে তুলেছিলেন, যার সমাপনী হয়েছিল সর্বশেষ মহান সুলতান আওরঙ্গজেব এর হাত ধরেই।

আজ উপমহাদেশের সেই মুঘল সালতানাতের অন্যতম সুলতান আওরঙ্গজেব আলমগীর এর মৃত্যুবার্ষিকী।

শত তাসলিম, সভ্যতার ঝাণ্ডা বুলন্দকারী বীর, মহান সুলতান আওরঙ্গজেব আলমগীর!

– সাদিয়া আরাবি

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *