শিউলিমালা একাডেমি

ষাট গম্বুজ মসজিদ


ভারতীয় উপমহাদেশের অনন্য স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন- মুসলিম স্মৃতিস্তম্ভ গুলোর মধ্যে অন্যতম সুলতানি আমলের ‘ষাটগম্বুজ’ মসজিদ। যার অবস্থান বাগেরহাট জেলা থেকে সাত কিলোমিটার পশ্চিমে খুলনা -বাগেরহাট মহাসড়কের উত্তর পাশে সুন্দরঘোনা গ্রামে।

মসজিদটির গায়ে কোনো শিলালিপি না থাকায় এটি কে, কখন, কীভাবে নির্মাণ করেছে সে সম্পর্কে সঠিক কোনো ধারণা পাওয়া যায় না। তবে কথিত আছে যে, চৌদ্দশ খ্রিষ্টাব্দের গোড়ার দিকে সম্রাট ফিরোজ শাহ তুঘলকের শাসনামলে সুদুর দিল্লির জৌনপুর থেকে ইসলাম প্রচারের লক্ষ্য এ অঞ্চলে ৬০ হাজার ভক্ত ও বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে আগমন করেন মহান সাধক হযরত খানজাহান (রহ:)। দীর্ঘ এ পথ যাত্রায় তিনি প্রথমে রাজশাহীর সোনা মসজিদ এলাকায় আসেন। পরে সেখান থেকে যথাক্রমে ফরিদপুর, যশোরের বারো বাজার, খুলনার বাশুয়ারী, ফুলতলা হয়ে বাগেরহাট এসে তাবু স্থাপন করেন। এখানে এসে বন-জঙ্গল পরিস্কার করে ২০ বর্গমাইলের একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন; যার নাম দেন ‘খলিফাতাবাদ’। পরবর্তীতে ১৫শ শতাব্দীতে তিনি এ মসজিদ নির্মাণ করেন।
তৎকালীন সময়ে ‘শৈ-গুম্বাদ’ নামে পরিচিত এই মসজিদটির নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৪৪২ সালে এবং সমাপ্ত হয় ১৪৯৯ সালে।

ষাটগম্বুজ মসজিদের নামকরণ নিয়েও রয়েছে নানা মতভেদ। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে, সংস্কৃত শব্দ ‘সাত’ ও ফারসি শব্দ ‘ছাদ’ এর সংমিশ্রণে এটি ‘ছাদগম্বুজ’ থেকে ষাটগম্বুজ হয়েছে। আবার কারো মতে, মসজিদের অভ্যন্তরে ছয়টি সারিতে দশটি করে মোট ষাটটি পাথরের খাম্বার উপর মসজিদের ছাদ নির্মাণ করা হয়েছে বলে এর নাম হয়েছে ষাটগম্বুজ মসজিদ।
কেউ কেউ মনে করেন, যেহেতু মসজিদটির ছাদ সমতল নয়, গম্বুজ আকৃতির; সেহেতু ছাদে গম্বুজ থাকায় মসজিদটি ‘ছাদগম্বুজ‘ নামে পরিচিতি লাভ করে। পরে কথ্যরুপে তা ‘ষাটগম্বুজ‘ নামে রুপান্তরিত হয়েছে।

জনশ্রুতি আছে যে, হযরত খানজাহান (রহ:) ষাটগম্বুজ মসজিদ নির্মাণের জন্য সমূদয় পাথর সুদূর চট্টগ্রাম থেকে এনেছিলেন। আবার কারো কারো মতে, ভারতের উড়িষ্যার রাজমহল থেকে অলৌকিক ক্ষমতাবলে তা জলপথে ভাসিয়ে এনেছিলেন। পুরো মসজিদ তৈরির মূল উপাদান চুন, সুরকি, কালোপাথর ও ছোট ইট। এই মসজিদের স্থাপত্যকলার সঙ্গে মধ্য এশিয়ার তুঘলক (তুরস্ক) স্থাপত্যশৈলীর মিল রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।

মসজিদটি ষাটগম্বুজ নামে পরিচিত হলেও এতে মোট গম্বুজ আছে ৮১ টি। মসজিদের চার কোণের মিনার বা বুরুজের উপরের ৪ টি গম্বুজ বাদ দিলে গম্বুজের সংখ্যা ৭৭টি। আর ৭৭ টি গম্বুজের মধ্যে ৭০টি গম্বুজের উপরিভাগ গোলাকার এবং মসজিদের মাঝ বরাবর গোলাকার গম্বুজগুলোকে ৭ টি চার কোণা বিশিষ্ট গম্বুজ দিয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব কোণের বুরুজটির ভিতর দিয়ে উপরে বা ছাদে উঠার একটি সিঁড়ি আছে, যার নাম ‘ রওশন কোঠা’। আর উত্তর-পূর্ব কোণের বুরুজটি দিয়েও উপরে উঠার সিঁড়ি রয়েছে, যেটি ‘আন্ধার কোঠা’ নামে পরিচিত। তবে বর্তমানে আন্ধার কোঠাটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ধারণা করা হয় , ‘খান-উল-আযম উলুঘ খান ই জাহান এই মসজিদটিকে নামাযের স্থান ছাড়া দরবার ঘর হিসেবেও ব্যবহার করতেন । মসজিদটি সে সময়ে মাদ্রাসা হিসেবে ব্যবহৃত হতো বলেও ধারণা অনেকের।
৮ ফুট উচ্চতার প্রাচীর ঘেরা এই মসজিদটি বাইরের দিক থেকে প্রায় ১৬০ ফুট ও ভিতরের দিক থেকে প্রায় ১৪৩ ফুট লম্বা। আর বাইরের দিক থেকে প্রায় ১০৮ ফুট ও ভিতরের দিক থেকে প্রায় ৯০ ফুট চওড়া। দেওয়াল গুলো প্রায় ৮.৫ ফুট পুরুত্বের। মসজিদের ভেতরে মেঝে থেকে ছাদের উচ্চতা প্রায় ২১ ফুট।
মসজিদের ভিতরের পশ্চিম দেয়ালে ১০টি মিহরাব আছে। মাঝের মিহরাবটি আকারে বড় এবং তুলনামূলক অধিক কারুকার্যময়। এ মিহরাবের দক্ষিণে ৫টি ও উত্তরে ৪টি মিহরাব আছে। মসজিদটিতে মোট ২৬ টি দরজা রয়েছে। পূর্ব দেওয়ালে ১১ টি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দেওয়ালে ৭ টি করে দরজা বিদ্যমান। আর পশ্চিম দেওয়ালে দরজার সংখ্যা ১টি । মসজিদের ভেতরের ৬০ টি স্তম্ভ বা পিলারই পাথর কেটে বানানো হয়েছে। এদের কয়েকটি আবার পাথরের বহিরাবরণে ইটের গাঁথুনি দিয়ে ঢাকা ছিল। ধারণা করা হয় মসজিদের প্লাস্টার বিহীন দেওয়ালের সাথে সামঞ্জস্য বজায় রাখার জন্য এমনটা করা হয়েছে।

মসজিদটির পশ্চিম পাশে রয়েছে ঐতিহাসিক ঘোড়া দীঘি, যা দৃষ্টিনন্দন এ মসজিদের সৌন্দর্যকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। শাসনভার কাঁধে আসার পর হযরত খানজাহানের অসংখ্য সংস্কারমূলক কাজের মধ্যে এই ঘোড়া দীঘি অন্যতম। কথিত আছে যে, তিনি যখন এই অঞ্চল জয় করেন তখন এ অঞ্চলে পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছিল। এই সংকট নিরসনের জন্য তিনি মসজিদের নিকটে এই বিশাল দীঘি খনন করেছিলেন। জনশ্রুতি মতে, খানজাহান ঘোড়ায় চড়ে সেটি মাপছিলেন বলে এর নাম হয়েছিল ঘোড়া দীঘি । আবার এটাও মনে করা হয় যে, তখনকার সময়ে এ এলাকায় ঘোড়ার প্রতিযোগিতা নামে একটি খেলা প্রচলিত ছিল। খেলায় ব্যবহৃত অনেক ঘোড়া এই দীঘির তীরে বাঁধা হতো, যার কারণে লোকেরা এটিকে ঘোড়া দিঘি বলতে শুরু করে।


হযরত খানজাহান (র:) এর সময়কালকে বুঝতে হলে ১৯৯৫ সালে ইউনস্কোর তহবিলের সাহায্যে মসজিদের দক্ষিণ- পূর্ব কোণে নির্মিত জাদুঘরটি পর্যবেক্ষণ করা বাঞ্ছনীয়। তিনটি গ্যালারি সংবলিত জাদুঘরে খানজাহানের ব্যবহার্য জিনিসপত্র এবং এই অঞ্চলের মুসলিম সংস্কৃতি ও স্থাপত্যসহ প্রাচীন কালের অনেক ফলক সংরক্ষিত রয়েছে।

পাঁচ শতাব্দীরও বেশি পুরনো এ বিশালাকৃতির মসজিদটি খান জাহানের দরগাহ হতে প্রায় দেড় কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত। স্থাপত্য কৌশল ও লাল পোড়া মাটির উপর লতাপাতার অলংকরণে মধ্যযুগীয় স্থাপত্য শিল্পে এ মসজিদ এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেস্কো ১৯৮৫ সালে মসজিদটিকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট গুলোর আওতায় আনে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মসজিদটি উপমহাদেশে মুসলিম স্থাপত্যের এক অনন্য নিদর্শন হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।


সংকলকঃ নাজিফা আঞ্জুম

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *