রাজনৈতিক চিন্তা আর ইতিহাসকে পরিবর্তন করতে হলে, ভাষার পরিবর্তন আবশ্যক। আবার ইতিহাস এবং বর্তমান দুনিয়াকে জানতে হলে, রাজনৈতিক পরিভাষাকে বুঝতে হয়, কীভাবে সেই পরিভাষা তৈরি হলো সেটাও জানতে হয়। কারণ ভাষা শুধুমাত্র মৌখিক আলাপের বাহন নয়, বরং একইসাথে চিন্তার মাধ্যম ও নিজস্ব বোধ, দর্শনের প্রতিফলন। কেননা, ভাষার একটা রূহ থাকে। সে ভাষা মূলত বাস্তবকে তৈরি না করলেও, বাস্তবের প্রতিফলন হয়ে উঠে। সুতরাং হাকীকতকে উপস্থাপন করতে হলে আসলে শক্তিশালী রূহসম্পন্ন, নিজস্ব ইতিহাস ও শেকড়ের সাথে সংযুক্ত থাকতে হয়। ভাষার এ রূহ, প্রাণশক্তিকে নষ্ট করতে না পারলে, দুর্বল না করতে পারলে চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব!
তাইতো বৃটিশরা ক্ষমতায় এসেই সুবা বাংলা/বাংলা সালতানাতে’র বাংলা ভাষাকে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরসহ হিন্দুত্ববাদী ঐতিহাসিকগণ, ভাষাতাত্ত্বিকদের দিয়ে আগ্রাসন চালালো, সংস্কৃতায়ন করে ইসলামী পরিভাষাকে শেষ করলো। আবার এ পরিভাষাগুলোকে বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রদের মতো প্রভাবশালী সাহিত্যিকদের মাধ্যমে মানুষের মন ও মননে পৌছে দিলো… আজ তাই পাশ্চাত্য ও হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বুঝাপড়া আমরা বুঝতে পারিনা, লাল ব্রাক্ষ্মণদের সাম্প্রদায়িকতার মানেও জানিনা!
একইভাবে আরবি, ফার্সির মতোই মুসলিমদের হাতে গড়া বৈশ্বিক ভাষা ‘উসমানী ভাষাকেও কামাল পাশাদের মতো পশ্চিমা আজ্ঞাবহ সেক্যুলার শাসকেরা ল্যাটিন শব্দ দিয়ে শেষ করেছে!
এ ভাষার পরিবর্তন তুর্কি মুসলিমদের জীবনে কি ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছিলো তা বলার বাইরে…। উসমানীদের ৬ শতাব্দীব্যাপী বিস্তৃত স্বর্ণালী শাসন ও জ্ঞানগত মিরাস থেকে নতুন প্রজন্ম সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলো। ফলশ্রুতিতে মুসলিম উম্মাহর একসময়কার নেতৃত্বদানকারী উসমানীদের তুরস্ক পরিণত হলো সেক্যুলার তুরস্কে!
আজ এসময়ে এসে যখন সব পরিভাষা/ভাষাগত অবস্থান হারিয়ে বসে আছি আমরা!তখন তারা ব্যবহার করছে মিডিয়া’কে..তাদের মিডিয়া, সাহিত্য যেভাবে ভাষাকে গড়ে দিয়েছে, – তার ভেতর দিয়ে খোদ অর্থ, প্রকৃতি সবই পাল্টে দিয়েছে!- নতুন করে তার দৃষ্টিভংগি ও চিন্তা’কে গড়ে তুলেছে!(পরবর্তীতে তাদের এসকল পরিভাষাই মূল ভাষা/পরিভাষা হিসেবে চলমান হচ্ছে)- মিডিয়া যেমন চায়, তেমন লেখক ও বুদ্ধিজীবী তৈরি করেছে, করছে। সে আলোকে বই, গবেষণাপত্র, পত্র-পত্রিকা সবক্ষেত্রেই প্রচুর কাজ হয়েছে। কারণ, মিডিয়া, সাহিত্য হচ্ছে শুধুমাত্র যুদ্ধের হাতিয়ার। কিন্তু এদের পিছনে থাকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিশন, ভিন্ন আদর্শ। সেই আইডিওলজির বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে তার পরিভাষা, তার বয়ান।আর, এই পরিভাষা ও বয়ান-ই পাল্টে দেয় মূল বিষয়কে! পাল্টে দেয় চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গিকে! যেমন ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আন্দোলনে কেউ শহীদ হলো, মিডিয়া নিউজ করলো ইসরাঈল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একজন জঙ্গী নিহত! অর্থ, উদ্দেশ্য, সবই পালটে গেল। এইজন্য মূল তথ্যের সাথে পরিভাষা, বয়ান বুঝা বেশি জরুরী। রাজনীতির গলি দিয়ে কারা এই বয়ান, এই পরিভাষা তৈরি করলো! কেন করলো! সেটা জানাও আবশ্যক।
ভাষা/পরিভাষা বয়ানের গুরুত্ব কতো জরুরী তা রাসূল (স.) এর বিপ্লবকে পর্যবেক্ষণ করলেই বুঝা যায়। সবার আগে তিনি ভাষার বিপ্লব করেছেন। যেমন, মরুভূমি সম্পর্কীয় হেদায়াত, হাদী, মাহদী এ শব্দগুলিকে কীভাবে বিশাল অর্থবহ পরিভাষায় পরিণত করেছেন, এসবই সবচেয়ে বড় উদাহরণ।আরবী এবং পরবর্তীতে ফার্সি, উসমানী, উর্দু সহ ভাষাগুলো যেভাবে ইসলামীকরণ হয়েছে, তার থেকেই আমাদের ভাষার রাজনীতি উপলব্ধি করা উচিৎ।
পশ্চিমাদের ভাষার রাজনীতির এ প্রক্রিয়াকে উম্মাহর মহান আলেম, দার্শনিক ও ভাষাতাত্ত্বিক সাইয়্যেদ নকীব আল আত্তাস বলেছেন- De Islamization Of Language। ভাষাকে যদি এভাবে অনৈসলামীকরণ করা হয়, তাহলে সে ভাষা থেকে দ্বীনের রূহ, প্রাণসত্তা, মূল অর্থ ও প্রভাব হারিয়ে যায়। তাই বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বড় রাজনীতি ভাষার, সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো পরিভাষার।
কেননা, ভাষা/পরিভাষা হচ্ছে, জাতির ভিত্তি নির্মাণে, ইতিহাসের সংযোগে, চিন্তার বাহন হিসেবে কর্মরত থাকে।
ভাষা/পরিভাষা হচ্ছে, সভ্যতা ও সংস্কৃতির মৌলিক উপাদান, শ্রেষ্ঠত্বের হাতিয়ার।
রাজনৈতিক বুঝাপড়া’তে ভাষার রাজনীতি তাই এতোটা গুরুত্ববহ, অন্যথায় কখনোই নিজেদের স্বকীয়তা রক্ষা করে সামনে অগ্ররসর হওয়া সম্ভব না। কেননা, শেকড়বিহীন কোনো গাছ কখনোই দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না।
-মুহসিনা বিনতি মুসলিম
