শিউলিমালা একাডেমি

বুলন্দ দরওয়াজা

বিশ্বের সর্বোচ্চ প্রবেশদ্বার এবং ভারতের অন্যতম একটি ঐতিহাসিক স্থাপত্যের নাম বুলন্দ দরওয়াজা। মুঘল সম্রাট আকবর গুজরাট বিজয় অভিযান স্মরণীয় করে রাখতে ১৬০১ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ভারতের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের ফতেহপুর সিকরিতে এটি অবস্থিত। আগ্রা থেকে ৪৩ কিমি দূরে অবস্থিত ফতেপুর সিক্রি মহলের প্রবেশের এটিই মূল দ্বার।

বুলন্দ দরওয়াজা মুঘল স্থাপত্যের একটি বিস্ময়কর উদাহরণ। এটি লাল এবং হলুদ বেলেপাথরে তৈরি, যার উপর সাদা এবং কালো মার্বেলে খোদাইকৃত নকশা রয়েছে। মাটি থেকে এর উচ্চতা প্রায় ৫৪ মিটার, চওড়া ৩৫ মিটার এবং দরজা অবধি মোট ৪২ টি সিঁড়ি রয়েছে। মুঘল স্থাপত্যে তৈরী মূল খিলানটির গায়ে লেখা লিপি থেকে আকবরের উদার ধর্মনীতি, ধর্মীয় সহনশীলতা এবং বিস্তৃত মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। মসজিদের আঙিনার উপরেই রয়েছে বুলন্দ দরওয়াজা মিনারটি। এর শীর্ষে অর্ধ-অষ্টভুজাকৃতির স্তম্ভ এবং ছত্র দ্বারা সাধারণ অলঙ্করণই সজ্জিত রয়েছে৷ আরো আছে মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের খোদাই করা আয়াত এবং সুউচ্চ খিলান সহ প্রাথমিক মুঘল নকশার প্রতিধ্বনি। ছাদে তেরোটি ছোট গম্বুজ বিশিষ্ট কেবিন। বাইরের দিকে একটি লম্বা ফ্লাইট ধাপে ধাপে পাহাড়ের নিচে নেমে গেছে যা প্রবেশদ্বারটিকে অতিরিক্ত উচ্চতা দিয়েছে।

বুলন্দ দরওয়াজার পূর্ব দিকের খিলান পথে ফার্সি শিলালিপিতে ১৬০১ খ্রিস্টাব্দে আকবরের দাক্ষিণাত্য জয়ের কথা লেখা রয়েছে । ইতিহাস, স্থাপত্য ও স্থাপত্য পরিকল্পনার এক অনন্য মিশেল এই স্মৃতিস্তম্ভ। এটি মুঘল সাম্রাজ্যের বিস্ময়কর এক নিদর্শন হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে যাতে হিন্দু ও পারস্যের স্থাপত্যশৈলী মিশ্রিত। এটিকে ‘গেট অফ ম্যাগনিফিসেন্স’ও বলা হয়।

গম্বুজ বিশিষ্ট গেটওয়ের প্রধান খিলানটি তিনটি প্রজেক্টিং বাহুর মাঝখানে অবস্থিত এবং তিন স্তরে বিভক্ত। সারিবদ্ধ ছোট খিলানগুলির পাশাপাশি সমতল বন্ধনী রয়েছে। দুটি ত্রিভুজাকার পৃষ্ঠ, যার প্রতিটির তিনটি বাহুর একটি খিলানের বাইরের বক্ররেখা দ্বারা আবদ্ধ এবং সাদা মার্বেল দিয়ে সীমানাযুক্ত। খিলানের অগ্রভাগও ফুলের মতো সাদা মার্বেল দিয়ে অলঙ্কৃত। কেন্দ্রীয় খিলানটিতে আবার তিনটি ছোট খিলান খোলা রয়েছে যা অলঙ্কৃত প্যানেল দিয়ে রূপরেখাযুক্ত এবং একটি আধা-গম্বুজ দ্বারা মুকুটযুক্ত। কাঠামোর বিশাল স্তম্ভগুলিতে পবিত্র কুরআনের উদ্ধৃতি সমন্বিত শিলালিপি ছাড়াও সূক্ষ্মভাবে খোদাই করা নকশা দ্বারা অলঙ্কৃত এবং দেয়ালগুলো জটিল নকশায় সজ্জিত।

সুউচ্চ খিলান, তাতে খোদাই করা পবিত্র কুরআনের আয়াত এবং প্রবেশদ্বারের সহজ এবং মার্জিত অলঙ্করণ মুঘল যুগের প্রথমদিককার নকশার এবং চারুশিকপের কথা মনে করিয়ে দেয়। এটিতে তিনটি অনুভূমিক প্যানেল রয়েছে যা বাদশাহী দরওয়াজা বা রাজকীয় প্রবেশদ্বারেও পাওয়া যায় যেটি ফতেপুর সিকরি জামে মসজিদ পথের পূর্ব প্রবেশদ্বার হিসাবে নির্মিত হয়েছিল। ফতেহপুর সিকরির বেশ কয়েকটি বিশাল এবং উল্লেখযোগ্য কাঠামোর মধ্যে বুলন্দ দরওয়াজাটি বিশ্বের সর্বোচ্চ প্রবেশদ্বার হিসেবে সবচেয়ে উঁচু অবস্থানে রয়েছে। সম্রাট আকবরের ধর্মীয় সহনশীলতা প্রবেশদ্বারের মূল ফটকের উপর খোদাই করা আরেকটি শিলালিপি থেকে প্রকাশ পায়। এটি ফার্সি ভাষায় খোদাই করা একটি ইসলামি শিলালিপি, যেখানে হাওয়ারীদের প্রতি যীশু খ্রিস্টের কিছু উপদেশ বর্ণিত হয়েছে। পবিত্র কুরআনের আয়াত সমন্বিত আরেকটি শিলালিপিও সেই প্রবেশদ্বারে পাওয়া যায় যেটি চিশতী ধারার সুফি সাধক শেখ সেলিম চিশতীর শিষ্য খাজা হোসেইন চিশতী দ্বারা আঁকা হয়েছিল। আরবি বর্ণমালায় লেখার জন্য একটি স্বতন্ত্র ক্যালিগ্রাফিক শৈলী নাসখ-এ এটি খোদাই করা হয়েছে।

আগ্রার কাছে অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটনস্থল ফতেহপুর সিক্রিতে অবস্থিত, বুলন্দ দরওয়াজা মুঘলদের স্থাপত্যের শ্রেষ্ঠত্বের সাক্ষী হয়ে রয়েছে। গ্রীষ্মকালে প্রচণ্ড গরম থাকায় এই ঐতিহাসিক শহরটি দেখার সর্বোত্তম সময় হলো নভেম্বর থেকে মার্চ, অর্থাৎ শীতকালে। ফতেপুর সিক্রির প্রবেশ বিন্দুতে অবস্থিত বিশাল কাঠামোটি প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পরিদর্শন করা যেতে পারে।

সংকলক: লামিয়া তাসনিম

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *