শিউলিমালা একাডেমি

বাবা আদম মসজিদ


সুলতানি আমলের দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যশৈলী গায়ে জড়িয়ে বাংলার মাটিতে দীর্ঘ ৫৩৮ বছর যাবত সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে বাবা আদম মসজিদ। ধলেশ্বরী নদীর তীরবর্তী মুন্সিগঞ্জের দরগাবাড়ীতে এই মসজিদের অবস্থান।

মসজিদটির নামের সাথে জড়িয়ে আছে দীর্ঘ এক ইতিহাস। সেই ইতিহাসের মাঝে সত্যতা ও জনশ্রুতি মিলিয়ে যা পাওয়া যায় তা অনেকটা এরকম- বাবা আদম ছিলেন একজন আধ্যাত্মিক সাধক। ১০৯৯ সালে তায়েফে তার জন্ম। তীব্র জ্ঞানপিপাসু এই ব্যক্তি জ্ঞান সাধনার জন্য ইরাকের বাগদাদে আব্দুল কাদির জিলানীর সাহচর্যে আসেন। পরবর্তীতে সেন শাসনামলে ১১৪২ সালে বাংলার চট্টগ্রামে পা রাখেন তিনি। সেখান থেকে ১১৫২ সালে মুন্সিগঞ্জ সদরের প্রাচীন রামপালনগরে আসেন। মুন্সিগঞ্জ এলাকার কপালদুয়ার, মানিকেশ্বর ও ধীপুরে তিনটি খানকাহ নির্মাণ করে ইসলাম প্রচার করেন তিনি। তিনি ছিলেন সে অঞ্চলের খুবই জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। সবাই তাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতো। ১১৭৮ সালের দিকে তৎকালীন শাসক বল্লাল সেনের বিপক্ষে যুদ্ধে শহীদ হন তিনি।

তার মৃত্যুর ৩১৯ বছর পর সুলতান জালাল উদ্দিন ফতেহ শাহের রাজত্বকালে মালিক কাফুর নামক এক শাসক এই মসজিদ তৈরি করেন। মসজিদটির সম্মুখভাগে কেন্দ্রীয় প্রবেশ পথের শীর্ষে উৎকীর্ণ শিলালিপি থেকে জানা যায়, এর নির্মাণকাল ৮৮৮ হিজরি, ১৪৮৩ খ্রিষ্টাব্দ।

বাবা আদম মসজিদ প্রাঙ্গণের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে একটি ক্ষুদ্র কবর আছে। ধারণা করা হয় সেটি বাবা আদমের কবর। তবে এ ব্যাপারে নিশ্চিত কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। বর্তমান কবরটি বর্গাকৃতির, তারিখ বিহীন এবং এতে কোনো শিলালিপি নেই। মৃত্যুর এত বছর পরে তার নামে তৈরিকৃত মসজিদ থেকেই ধারণা পাওয়া যায় যে তিনি কতটা জনপ্রিয় ছিলেন; মানুষের মুখে মুখে ছিল তার নাম।

পোড়ামাটির লাল ইটের তৈরি এই মসজিদটি বহু গম্বুজ বিশিষ্ট এবং আয়তাকৃতির। এটি দেখতে অনেকটাই সুরক্ষিত দুর্গের মত। এটি সম্ভবত এ কারণে যে ইবাদতে মশগুল থাকাবস্থায় মুসলমানরা যাতে কারও হামলার স্বীকার না হন। চার কোণায় চারটি অষ্ট কোণাকৃতির বুরুজ বা মিনার। একটি মিনারও ছাদের কার্নিশের উপর উঠেনি। সে অর্থে বাইরে থেকে দৃশ্যমান কোনো মিনার এই মসজিদে নেই। মিনারের ধাপে ধাপে মনোরম অলঙ্করণ দেখা যায়।

মসজিদের দেয়াল ২ মিটার পুরু। পশ্চিমের দেয়ালে তিনটি অর্ধবৃত্তাকার মিহরাব রয়েছে। পশ্চিম দেয়ালের পেছনের অংশটি বাইরের দিকে তিন স্তরে বর্ধিত। মাঝখানের স্তরে নকশাকৃত বহু খাঁজ বিশিষ্ট খিলানের প্যানেল বিদ্যমান। মসজিদে প্রবেশের তিনটি দরজা রয়েছে, যার মধ্যে বর্তমানে মাঝেরটি ব্যবহৃত হয়। এতে কোনো বারান্দা নেই।

এই মসজিদের ছাদে একই ধরনের ছয়টি গোলাকার গম্বুজ রয়েছে। গম্বুজগুলো খুব বেশি উঁচু নয়। গম্বুজগুলো পর্যায়ক্রমে দুই সারিতে স্থাপিত।

মসজিদের ভেতরের অংশে রয়েছে দন্ডায়মান দুইটি কালো ব্যাসল্ট (অগ্নিয়গিরিজাত শিলা) পাথরের স্তম্ভ। ধারণা করা হয়, সেগুলো প্রাক মুসলিম যুগের কোনো পরিত্যক্ত ইমারতের অংশবিশেষ। এই স্তম্ভ দু’টি মাঝ থেকে চার ফুট পর্যন্ত অষ্টভুজাকার, এরপর ষোল কোণাকৃতির। সেগুলো শিকল ও ঘন্টার আদলে নকশাকৃত। মসজিদের ভেতরের অংশটি এই দুটি স্তম্ভের সাহায্যে পূর্ব পশ্চিমে দুই সারিতে এবং উত্তর দক্ষিণে তিন সারিতে বিভক্ত। মোট ছয়টি কাতারের ব্যবস্থা আছে এখানে।

মুসলিম আমলের পূর্ববর্তী পাথরের পিলারগুলোর উপর মসজিদের সরু পিলারগুলো দাঁড়িয়ে আছে এবং তার উপরেই ছয়টি গম্বুজ স্থাপিত। মসজিদটি ইটের হলেও এর পিলার এবং আয়তাকার স্তম্ভগুলো পাথরের তৈরি।

সুলতানি আমলের অধিকাংশ স্থাপনার মত এই মসজিদের কার্নিশ এবং ছাদ বক্ররেখা বেষ্টিত। মসজিদের পশ্চিম দেয়ালের মিহরাবের সাথে সমান্তরালভাবে পূর্বদিকে তিনটি চমৎকার বক্রাকার ফটক রয়েছে।

বাবা আদম মসজিদের খিলান ও ছাদের মধ্যকার অংশে সুন্দর সব গোলাপের নকশা কাটা। সেই সাথে সেখানে ছাঁচের নকশায় প্রস্তুতকৃত কুলুঙ্গির সারিও রয়েছে। সবকটি ফটক ও মিহরাবে আয়তক্ষেত্রাকার নকশা খোদাই করা এবং উত্তর ও দক্ষিণের দেয়ালে আয়তাকার কুলুঙ্গি রয়েছে। মাঝের ফটকের দু পার্শ্বে বহু খাঁজ বিশিষ্ট দুটি আয়তক্ষেত্রাকার প্যানেল উপস্থিত। যে ছোট পিলারগুলোর উপরে বাবা আদম মসজিদের খিলানগুলো দাঁড়িয়ে আছে, সেগুলোতে চোখ জুড়ানো টেরাকোটার নকশা বিদ্যমান।

মসজিদটিতে সুলতানি আমলের স্থাপত্যরীতি ও অলংকরণশৈলী প্রকাশ পেয়েছে। বাংলা অঞ্চলের মসজিদ স্থাপত্যে সুলতানি স্থাপত্যরীতি পরিণত রূপ লাভ করেছে বাবা আদম মসজিদে, তা বললেও অত্যুক্তি করা হবে না।

কয়েক শত বছরের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে টিকে থাকা এ স্থাপনা আমাদের গর্বের ধন। তবুও এটি সংরক্ষণে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। ১৯০৯ সালে ভারতবর্ষ প্রত্নতত্ত্ব জরিপ বিভাগ একবার এ মসজিদটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয় কিন্তু তা আর আলোর মুখ দেখেনি। ১৯৪৮ সাল থেকে বাংলাদেশ সরকারের পুরাতত্ত্ব বিভাগ এ মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণের ভার কাঁধে নেয়। তারই সূত্রে ১৯৯১ সালের দিকে মসজিদের চারপাশে লোহার সীমানা বেড়া নির্মিত হয়। একই বছর বাংলাদেশ ডাক বিভাগ বাবা আদম মসজিদের ছবি সম্বলিত ডাকটিকিট প্রকাশ করে।



সংকলক: তাহারাতুন তাইয়্যেবা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *