শিউলিমালা একাডেমি

পথশিশু

‘পথশিশু’, যাদের থাকার কোনো নির্দিষ্ট স্থান নেই, যাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব কারো উপর নেই এবং যারা অভিভাবকহীন।
রিপোর্ট মোতাবেক বাংলাদেশে পথশিশুর সংখ্যা প্রায় ৫০ লাখ। এ সংখ্যা অতিরিক্ত মনে হতে পারে, তবে কোনো সন্দেহ নেই যে, পথশিশুর সংখ্যা সারা দেশে অন্তত ১২/১৩ লাখ এবং এর ৭৫-৮০ শতাংশই ঢাকায়।

পথশিশুরা সবার আগে আবাসন থেকে বঞ্চিত। তাদের থাকার বা বসবাসের জন্য সুন্দর আবাসন নেই, এজন্যই মূলত তাদের নামকরণ করা হয়েছে ‘পথশিশু’। শীত, গ্রীষ্ম, খরা কিংবা ঝড়– সব অবস্থায়ই তাদের জায়গা হয় নির্মাণাধীন পাইপ লাইন, ফুটপাথ, ব্রীজের নিচে কিংবা রেলের খোলা প্ল্যাটফর্মে।

পথশিশুরা খাদ্য বঞ্চিত। খাবার পায় না, কুড়িয়ে খাবার খেতে বাধ্য হয় বিধায় আমরা তাদের চিনি ‘টোকাই’ হিসেবে।

পথশিশুরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত, যার ফলে অন্য কোনো কাজ না থাকায় তারা মাদক সেবন করে, মাদক ব্যবসার বিভিন্ন পর্যায়ে জড়িয়ে পড়ে। প্রাথমিকভাবে পেট চালানোর জন্য ‘হাতের কাজ’ তথা পকেটমার, চুরি, ছিনতাই শিখলেও পরবর্তীতে এসব তাদের পেশায় পরিণত হয়, যার সরাসরি ভুক্তভোগী আমার-আপনার মতো নিরীহ নগরবাসীরা।

পথশিশুরা স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত। আমাদের দেশে পরিবারে আছে, আয়-ইনকাম আছে এমন মানুষও টাকা খরচ করে চিকিৎসা পায় না, সে জায়গায় পথশিশুদের স্বাস্থ্য সেবা তো শুধু মুখের বুলি! এ বিষয়টা কারো মাথায়ই আসে না। আর আমাদের মস্তিষ্ক এভাবে ট্রেইন্ড হয়ে যাওয়ায় সবচেয়ে বড় যে সমস্যাটা হয়েছে তা হলো এমন এমন সব সিন্ডিকেট গড়ে উঠছে, যারা পথশিশুদের ধরে নিয়ে বিকলাঙ্গ করে ভিক্ষা করতে বাধ্য করছে। ভাবতে পারেন? স্বেচ্ছায়, সজ্ঞানে রীতিমতো অঙ্গহানি করে এক একটা বাচ্চাকে জীবন্ত নরকে ছেড়ে দেওয়া! রাস্তাঘাটে, বাসে, টার্মিনালে একটু চোখ মেলে তাকালেই তাদের দেখতে পাবেন।

এগুলো হলো যা আমরা আমাদের চোখের সামনে দেখতে পাই, তার আলাপ। ভয়াবহ হিসেবে যেসব জিনিস আল্লাহর এই দুনিয়ায় বিদ্যমান, তার সবই মোকাবেলা করে এই শিশুরা।

পথশিশু হোক কিংবা আপনার আমার ঘরের নয়নমণি হোক, শিশু তো শিশুই। একজন বোধসম্পন্ন, সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ হিসেবে কখনো কি আমরা যে শিশুটা পথশিশু, তাকে তার ভাগ্যের দোষ দিয়ে সব ধরনের ভয়াবহতার হাতে ছেড়ে দিতে পারি? কিন্তু আফসোস! কোনো চিন্তা না থাকার কারণে আমরা তাদেরকে তাদের ভাগ্যের উপর ছেড়েই দিয়ে বসে আছি। এ যে গোটা মানবতার উপর অভিশাপ!

তাহলে তাদেরকে একটি নিরাপদ জীবন উপহার দেওয়ার ক্ষেত্রে করণীয় কী?

করণীয় অনেক কিছুই, তবে তা পর্যায় ভেদে।
আমাদের দেশে সাধারণত যা হয়, তা অনেকের কাছে খুব পবিত্র মনে হলেও আদতে এটি অসহনীয়; ‘পথশিশু ফাউন্ডেশন’ ধরনের কিছু খুলে বসে সেলিব্রেটি বনে যাওয়া, ১৫-২০ জন লোক নিয়ে দিনব্যাপী একটি ক্যাম্পেইন চালিয়ে, দুই-এক পাতিল খিচুড়ি এক-দেড়শো পথশিশুকে খাইয়ে, ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে লাইক-শেয়ারের জোয়ারে ভেসে ভার্চুয়াল আত্মতৃপ্তি অর্জন করা।
তবে যারা এ ধরনের কাজ করছে, তারা তাদের সাধ্যমতোই করছে, এক্ষেত্রে কোনো সমস্যা নেই। আসল সমস্যা হলো স্থায়ী সমাধান নিয়ে কথা না বলা।
এসব সংগঠন কয় বেলা খাওয়াতে পারে টোকাইদেরকে? কয়টা শিশুর চিকিৎসা করাতে পারে? কয়টা শিশুকে সিন্ডিকের জাহান্নামী কবল থেকে মুক্ত করে স্বাভাবিক জীবন দান করতে পারে? কিছুই তো পারে না! দিনশেষে শুধুমাত্র ওই ফটোসেশনেই সীমাবদ্ধ!

এসবের পরিবর্তে যা করা দরকার ছিলো তা হলো–

  • চিন্তা করা।
  • স্থায়ী সমাধানের কথা বলা।
  • তাদেরকে রক্ষা করা যেহেতু রাষ্ট্রের কাজ, তাই রাষ্ট্রের কাছে যথাযথ পদক্ষেপের জন্য পরিকল্পনা ও রোড ম্যাপ পেশ করা।

যাই হোক! আজকে রাতে যখন আপনার ঘরের নয়নমণিটাকে ব্রাশ করে শুয়ে যেতে বলবেন, ঘুম পাড়াবেন, ‘গুড নাইট’ জানাবেন, মশারী টাঙ্গিয়ে ভালোভাবে গুঁজে দিবেন, তখন এই লাইনটা একটু স্মরণ করবেন– ‘লক্ষ মশার উৎপাতে, ঘুম আসে না ফুটপাথে…’

রাস্তায় রাস্তায় ধুঁকতে থাকা শিশুগুলোর কী দোষ ছিলো যে, তারা মাথা গোজার ঠাঁইও পায় না? আর আপনার সন্তান কিংবা ছোট ভাই-বোনটার কী গুণ বেশি ছিলো যে, তাদেরকে আপনি সর্বোচ্চ মমতা দিয়ে আগলে রাখেন? একই শহরের বাসিন্দা দুই শিশু, অথচ…

ভাবেন, আল্লাহর ওয়াস্তে ভাবেন।
ভাবতে থাকেন, তাহলে একদিন মুক্তি আসবেই…

-মাহফুজা শিমু

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *