শিউলিমালা একাডেমি

“নীল মসজিদ” এর কালজয়ী সৌন্দর্য


উজবেকিস্তানের উত্তর সীমান্ত থেকে ৩৫ মাইল (৫৬ কি.মি) দক্ষিণে ১২৫০ ফুট (৩৮০ মিটার) উচ্চতায় নির্মাণকৃত আফগানিস্তানে অবস্থিত এই বিখ্যাত “নীল মসজিদ” কে আখ্যায়িত করা হয় শান্তির মরুদ্যান হিসেবে। মহানবী (সঃ) এর জামাতা খলিফা হযরত আলী (রাঃ) স্বনামধন্য সমাধি থেকে শহরটির নামকরণ করা হয় ‘মাজার-ই-শরীফ’। এখানে অবস্থিত তার পবিত্র সমাধির উপর পঞ্চদশ শতাব্দীতে একটি নীল রঙের মসজিদ এবং মন্দির নির্মিত হয়েছিল। আফগান ইতিহাস অনুসারে, সমাধিটি দ্বাদশ শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত হয়। চমৎকার এই মসজিদের চারদিক ঘিরে রয়েছে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়তে থাকা হাজার হাজার সাদা ঘুঘু। যেন সত্যিই তা শান্তির শুভ্র প্রতীক বলেই মনে হয়। এর চারপাশে বেড়ে ওঠা বৃক্ষ, ছাদ এবং পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার রাস্তায় সর্বদাই বিরাজ করে ঘুঘুদের ঝাঁক। জনশ্রুতি আছে – মসজিদটি এত পবিত্র যে, কোনো ঘুঘু যদি তার পালকে রঙের আঁচড় দিয়ে মসজিদের আশেপাশে প্রবেশ করে, মুহুর্তেই তা সাদা রঙে পরিণত হয়ে যায়।

ঐতিহাসিকভাবে জানা যায়, মধ্যপ্রাচ্যের একজন মোল্লা (ইসলামের পণ্ডিত) একবার একটি স্বপ্ন দেখেছিলেন যে, নবী মুহাম্মদের জামাতা এবং চাচাতো ভাই আলি বিন আবু তালিবের হাড় এখন উত্তর-পশ্চিম আফগানিস্তানে রয়েছে। ১১১৮ থেকে ১১৫৭ সাল পর্যন্ত শাসনরত সেলজুক সাম্রাজ্যের সুলতান আহমেদ সানজার তার গল্পে মোহিত হয়ে উত্তর-পশ্চিম আফগানিস্তানে আলীর মাজার নির্মাণ করেছিলেন। এমনকি তিনি মাজার-ই-শরীফ নামক মাজারের আশেপাশে একটি শহরও নির্মাণ করেন, যেখানে হাজার হাজার ধর্মীয় মুসলমানরা স্থানান্তরিত হয়েছিল।

আফগানরা বিশ্বাস করত যে তার মৃতদেহ এই স্থানে আফগান শহর মাজার-ই-শরীফে নিয়ে গিয়েই দাফন করা হয়েছে। শত্রুদের অবহেলা ও অপমান থেকে তার দেহাবশেষ রক্ষা করার জন্য আলীকে একটি সাদা উট দ্বারা এখানে আনা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয় । তবে শিয়া মুসলমানরা বিশ্বাস করেন, হযরত আলীকে ইরাকের নাজাফের ‘ইমাম আলী মসজিদে’ সমাহিত করা হয়েছে। অনেকে এভাবেও মত প্রকাশ করেন যে, হযরত আলীর মাজার শনাক্ত করা সম্ভবত একটি কল্পকাহিনী হতে পারে যার মাধ্যমে ইসলামী প্রতিষ্ঠানের দ্বারা সমাধিকে সুরক্ষিত ও সম্মানিত করা যায় ঐতিহাসিকগণের অধ্যয়ন সাপেক্ষে বলা যায়, মাজারের মালিক আলী ইবনে আবি তালিব আল-বালখী, তার সময়ে বালখের আলেভিসের অধিনায়ক ছিলেন। সেলজুক বংশের সুলতান আহমেদ সানজার এই স্থানে প্রথম পরিচিত মাজার নির্মাণ করেন এবং ১২২০ সালের দিকে চেঙ্গিস খানের আক্রমণের সময় এটি ধ্বংস করা হয় কিংবা মাটির বাঁধের নিচে লুকিয়ে রাখা হয়। পঞ্চদশ শতকে তৈমুরিদ সুলতান হোসেন, মির্জা হযরত আলীর সমাধির উপর একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। এটি মাজার-ই-শরীফের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ল্যান্ডমার্ক হিসেবে পরিগণিত হয়। তারপর থেকে সকলের বিশ্বাস এই সমাধির থেকেই শহরের নামটির উৎপত্তি হয়েছে।

১০১০-এর দশকে করা এই স্থানের একটি সাইট প্ল্যান খুঁজে পাওয়া যায় যেখানে দেখানো হয়, আগে মসজিদটি একটি ছোট দেয়াল ঘেরা এলাকা ছিল, যা পরবর্তীতে পার্কের জমি তৈরির জন্য ভেঙে ফেলা হয়। যদিও এই প্রান্তের পোর্টালগুলি এখনও মঠঘরটির প্রবেশদ্বার হিসেবেই রয়ে গেছে। কয়েক বছর ধরে আফগানিস্তানের রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় নেতাদের জন্য বিভিন্ন মাত্রার সমাধি যুক্ত করা হয়েছিল। এর মধ্যে রয়েছে আমির দোস্ত মুহাম্মদ খান, উজির আকবর খানের বর্গাকার গম্বুজ সমাধি এবং আমির শের আলী এবং তার পরিবারের জন্য অনুরূপ কাঠামো। একটি স্থানীয় কিংবদন্তি দাবি করেন যে পুরো মসজিদটি একবার মঙ্গোল সেনাবাহিনীর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য একবার পুরোপুরি মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল যদিও এই দাবির পক্ষে কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ১৪৮১ সালে সুলতান হুসাইন মির্জা একটি বিশাল নীল মসজিদের আকারে আলীর মাজারটি আরও বড় করে পুনর্নির্মাণ করেছিলেন যার অস্তিত্ব আজও বিদ্যমান।

এর স্থাপনার দিকে লক্ষ্য করলে মনে হয় কাঠামোটিকে ভাসমান অবস্থায় আছে । কিন্তু এতে জটিলভাবে আঁকা একধরনের মাটির টাইলস ব্যবহার করা হয় যা মূলত ইসলামী স্থাপত্যের একটি কৌশল। প্রাকৃতিক উপাদানের সংস্পর্শ থেকে প্রতিদিন দুই বর্গফুট করে ক্রমাগত টাইলসগুলি প্রতিস্থাপন করার প্রয়োজন হয়। কারণ কিছু কিছু টাইলস এর কোণগুলো প্রায়ই ধর্মীয় স্মারক হিসেবে তীর্থযাত্রীরা চুরি করে থাকে। এর দেওয়ালগুলো হাজার হাজার রঙিন এবং জটিল প্যাটার্নযুক্ত টাইলসে সজ্জিত যা মরীচিকার মতো সূর্যের আলোতে জ্বলজ্বল করে। এখানে দর্শনের নিমিত্তে আসা সমস্ত মানুষের চোখ দেয়ালের এই নকশার দিকেই যেন আটকে যায় এবং পার্কে আসা প্রায় প্রত্যেকেই এটি পরিদর্শন করে। তারা পরিবার পরিজন নিয়ে মসজিদের ফ্ল্যাগস্টোন কোর্টে ঘুরে বেড়ায়। কেউ কেউ মসজিদের ছোট জাদুঘরটি পরিদর্শন করে। এখানে অনেক তীর্থযাত্রীও আছেন যারা পুরো আফগানিস্তান এবং এর বাইরে থেকে এসেছেন। তারা কমপ্লেক্সের সবচেয়ে বড় শাখা এবং শুধুমাত্র বিশ্বস্তদের প্রবেশের জন্য উন্মুক্ত হযরত আলীর মাজার পরিদর্শন করতে পারে। মাজারে রয়েছে আলীর সমাধি, নবী মুহাম্মদের চাচাতো ভাই ও জামাতা। এখানে বসবাসকারীরা কেউ কেউ বিশ্বাস করে যে তার মরদেহ ইসলামের ইতিহাসের প্রথম দিকে ইরাকের আল-নাজাফে তার মূল কবরস্থান থেকে আফগানিস্তানে স্থানান্তরিত হয়েছ

আধুনিক শহরের কোলাহলে ঘেরা ব্লক আকারের পার্কটির রাস্তার পাশে রয়েছে ছোট ছোট দোকান এবং ফুটপাথের বাজার যেখানে সর্বদাই অনেক অনেক মানুষের ভিড় জমে থাকে। কিন্তু পার্কে প্রবেশ করার সাথে সাথে শহুরে আওয়াজ কমে যায়। সেখানে বাচ্চাদের হাসি এবং উড়তে থাকা তুষার সাদা ঘুঘুদের গোলাপী রেখাযুক্ত পথ জুড়ে বিচরণ এক স্নিগ্ধতার পরশ বুলিয়ে দেয় সকলের মনে। সাদা রঙের ঘুঘু কপোতীদের দেখলে মনে হয় তারা এখানকারই বাসিন্দা । মসজিদ কমপ্লেক্সের এক পাশে রয়ছে কবুতরের বাসা। এটি বেশ বড়, কম কংক্রিটের একটু বাক্স যার সাথে ছোট জানালা রয়েছে এবং এর বেশিরভাগ অংশই মাটির নিচে। এখানেই ঘুঘু বাসা বাঁধে এবং সারা বছর প্রজনন করে। মাজারের বাইরে সমতল ছাদে কবুতরের তত্ত্বাবধায়কের টিনফুলের বীজ ছড়িয়ে দেওয়ার দৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। কবুতরগুলোকে দেখে মনে হয় যেন সাদা ডানার অনেকগুলো মেঘ মাত্রউ উপস্থিত হচ্ছে আবার অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। এমন দৃশ্য যেন সত্যিই আমাদের হৃদয়কে দ্রবীভূত করে।

‘নীল মসজিদ’ এর নয়নাভিরাম রূপ, এর পরিবেশ মাজার-ই-শরীফের আশপাশের রাস্তাঘাট এবং বাজারের হৈচৈ, গোলমাল ও কর্মব্যস্ততাপূর্ণ পরিবেশ থেকে একটুখানি মুক্ত হয়ে প্রশান্ত হৃদয়কে আলিঙ্গন করার অভিপ্রায় জানায়। সমাধিটি সকল মুসলমান বিশেষ করে শিয়া সম্প্রদায়ের দ্বারা শ্রদ্ধাশীল। প্রতিদিন যখন মুয়াজ্জিন নামাজের জন্য মুসল্লিদের নীল মসজিদে আহ্বান করে, কেবল সে সময় ব্যতিরেকে সর্বদাই এখানে মন্থর, কোলাহলশূন্য এক শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করে।

সংকলক: লামিয়া তাসনিম

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *