মানবতার মুক্তির সফরে জ্ঞান ও সংগ্রাম একে অপরের পরিপূরক, কোনটিই একা পরিপূর্ণ নয়। তবে জ্ঞান অর্জন কেন করবো সেটা ভালোভাবে বুঝা বর্তমান সময়ে আবশ্যকীয় ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে।
প্রতি শতাব্দীতে যদি আমরা দেখি, ইসলামের আলেমগন সেই শতাব্দীকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছেন এবং এই সংজ্ঞায়নের ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু শব্দ বা পরিভাষার সৃষ্টি করেছেন। এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোরআনী পরিভাষা হলো তাওহীদ। তাওহীদ আমাদেরকে যে বিষয়টি ভালভাবে উপলব্ধি করতে শেখায় তা হল, পাশ্চাত্য বা বাতিলের মধ্যে তাওহীদ না থাকার কারণে তাদের চিন্তা বা মাথা সম্পূর্ণ ফাংশন করতে পারেনা বা কাজ করেনা। ফলশ্রুতিতে তারা যতোকিছুই করুক, তাদের পক্ষে কখনোই মানবতার মুক্তি আনয়ন সম্ভব না।
তাওহীদের শিক্ষা হচ্ছে, ওহী যেমন আমাদের জন্য জ্ঞানের উৎস, একইভাবে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড বা মহাবিশ্বও আমাদের জন্য জ্ঞানের উৎস। কেননা যিনি ওহী প্রেরণ করেছেন তিনিই মহাবিশ্বকে সৃষ্টি করেছেন, অর্থাৎ– তিনি একই রব। মহান রবই এ সকল কিছু দিয়েছেন এবং করেছেন।
ফলশ্রুতিতে ইসলামি সভ্যতার যে আলেমগন ওহীভিত্তিক জ্ঞানের (সরাসরি নসগত জ্ঞান যেটা) ক্ষেত্রে যেমন বুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন; সেই সাথে ফিজিক্স, ক্যামিস্ট্রি, অ্যাস্ট্রোনমি, মেডিসিনসহ সকল জ্ঞানের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিলেন বা শ্রেষ্ঠত্বের সর্বোচ্চ সীমায় উপনীত হয়েছিলেন। যার ফলে বর্তমান যুগে একটা চিন্তা দাঁড় করানোর জন্য শুধুমাত্র হাদীস এবং ওহীভিত্তিক জ্ঞান যথেষ্ট নয়, সাথে আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যোগ করা দরকার, তা হলো পজেটিভ সাইন্স অর্থাৎ ফিজিক্স, ম্যাথমেটিক্স বা এ ধরণের জ্ঞানসমূহ। আমরা যদি বর্তমান সময়ে যারা একইসাথে আলেম ও মুজাহিদ তাদেরকে দেখি, যেমন আল্লামা ইকবাল, আলিয়া ইজ্জতবেগভিচ, ইসমাইল রাজী আল ফারুকী, নাজমুদ্দিন এরবাকানদের মত মহানদের দেখি তবেই এর মর্মার্থ বুঝতে পারি।
তাই, জ্ঞানকে আমাদের দুই পাখাবিশিষ্ট একটা কিছু হিসেবে দেখা উচিত।
- দুই পাখার একটি হচ্ছে, মহাবিশ্ব এবং ওহীকে ভিত্তি হিসেবে গ্রহণকারী;
- আরেকটি হচ্ছে, প্র্যাকটিকাল বা বাস্তব, জীবন ব্যবস্থা বা জীবনের প্রতিফলন।
আবার এই দুইটা জিনিস যদি একত্রিত হয় অর্থাৎ জ্ঞান যখন পরিপূর্ণতায় পৌঁছায়, তখন আরেকটা জিনিসের সৃষ্টি হয়, সেটা হলো “আখলাক”।
এখন আমরা যদি আখলাককে সঠিকভাবে ডিফাইন করতে চাই, তাহলে ওহী এবং মহাবিশ্বকে একসাথে পড়তে হবে এবং দু’টো উৎস থেকেই রিসোর্স সংগ্রহ করতে হবে। এসবের সমন্বয় ব্যাতীত আমরা অগ্রসর হলে তা অধিকাংশই ফলাফল শূণ্য জ্ঞানচর্চা হিসেবেই থেকে যায়। এজন্য রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “আমি সেই জ্ঞান থেকে তোমার নিকট পানাহ চাই, যে জ্ঞান কোনো উপকারে আসে না ।”
এই উপকার বা ফায়দা আসলে কীসের জন্য? এ উপকার হচ্ছে তিনটি বিষয়ের জন্য,
•প্রথমত আমাদের নিজেদের জন্য বা ব্যক্তিগত।
•দ্বিতীয়ত আমাদের সমাজের জন্য।
•তৃতীয়ত সমগ্র মানবতার জন্য।
♦ ব্যক্তিগত ফায়দা হিসেবে যা বুঝানো হয়েছে, ব্যক্তিকে পূর্ণতায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য বা ইনসানে কামিল, আর এটা নিয়ে আলোচনা করেছে তাসাউফ। তাই এটাকে বলাহয় তাসাউফের ধারা(স্কুল)।
♦ সমাজের জন্য যে ফায়দা, যেটা আমাদের সামাজিক ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নকে মেক্সিমাইজ করে, সেটাকে সামাজিক আখলাক বলা যায়। এই সামাজিক আখলাক আমাদের শেখায় আমরা সমাজে কীভাবে বসবাস করবো, অন্য মানুষের সাথে আমাদের সম্পর্ক কেমন হবে, কিসের উপর ভিত্তি করে আমরা অন্য মানুষের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করবো এবং চলবো।
♦ সমগ্র বিশ্বের মানবতার জন্য যে ফায়দা, তা সিস্টেম বা ব্যবস্থার আখলাক। তবে এটা সামাজিক সিস্টেমের মতো না, এটা হলো আমি দুনিয়াকে কিভাবে রিড করি, ওয়ার্ল্ড ভিউ আমার কেমন হবে সেটা বুঝতে পারা। যেমন পয়গম্বর হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত রাজনীতি কেমন ছিলো, কিভাবে হয়েছিলো এটাকে খুব ভালোভাবে রিড করতে হবে, খুব ভালোভাবে বুঝতে হবে। বর্তমানে যে ন্যাশন স্টেট আছে, আমরা সবাই এটাকে ধারণ করি। এটা কিসের ফলাফল? এটা ওয়েস্টের ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভুলেশনের পরে ক্যাপিটালিজমের সৃষ্ট একটা ফলাফল। এভাবে বুঝতে পারা।
এখন কথা হলো এই আধুনিক সময়ে আমরা কিভাবে আখলাককে এখানে এডাপ্ট করবো। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক বিষয়, কারণ আমাদের ওয়ার্ল্ড ভিউ বা দুনিয়ার ব্যাপারে যে দৃষ্টিভঙ্গি তা আমাদের আখলাককেও গঠন করে দেয়। ওয়ার্ল্ড ভিউ থেকে আমাদের আখলাক তৈরী হয়, এটা খুবই প্রাকৃতিক।
এক্ষেত্রে আবার খেয়াল রাখতে হবে, আমরা যদি ব্যবস্থার/সিস্টেমের আখলাক নিয়ে আলোচনা করতে চাই, তাহলে আমরা যে যুগে বসবাস করছি যে যুগকে ভালোভাবে ডিফাইন করতে হবে, বুঝতে হবে, এমনকি আমাদের অর্থাৎ মুসলমানদের হাতে কী কী সুযোগ আছে এগুলোকে খুব ভালোভাবে জানতে হবে, চিনতে হবে।
যেমন একটা হাদীস আছে, “মুসলমানরা হচ্ছে একটা দেহের মতো, যদি তার কোনো অঙ্গ রোগে আক্রান্ত হয়, সে যে রকম অনুভব করে, দুনিয়ার কোনো অংশের মুসলমান যদি আক্রান্ত হয়, তাহলে মুসলমানদের একইভাবে অনুভব করা উচিত, অনুভব করতে হবে।”
এটা কীভাবে সম্ভব?
আমরা যদি আমাদের এ যুগে বা বর্তমান সময়ে সিস্টেমের আখলাক বা ব্যবস্থাপনার আখলাককে ধারণ করতে না পারি, বুঝতে না পারি, তাহলে এ হাদীসকে বুঝা অসম্ভব, এমনকি আমরা কোনক্রমেই এর অর্থ উপলব্ধি করতে পারব না এবং অন্যজনের ব্যথাকেও বুঝতে পারব না। যেমন আমরা রাজনৈতিকভাবে যখন এ সকল বিষয়কে বিশ্লেষণ করি, তখন আমরা মূলত সেগুলো রাজনীতির জন্য করিনা, কেননা আমাদের রাজনীতির মূলে রয়েছে জিহাদের রূহ।
জিহাদ ছাড়া জ্ঞানের সামগ্রিকতা অর্জন সম্ভব নয়, জিহাদ ছাড়া জ্ঞান কখনোই পূর্ণতা পাবেনা, শুরুতেই দুইটা পাখার কথা যে বলা হল, একটা জ্ঞান অন্যটা জিহাদ/বাস্তব/প্র্যাকটিকেল সংগ্রাম। এই দুইটা যখন একসাথে হবে তখন সঠিক অর্থে আমাদের মাঝে আখলাকের সৃষ্টি হবে।
এজন্য শুধুমাত্র আমাদের নিজেদের দেশের ভেতরে শক্তিশালী হওয়া যথেষ্ট নয়; আমরা যদি বর্তমান গ্লোবালাইজেশন বা গ্লোবাল সিস্টেমকে বুঝতে না পারি, পড়তে না পারি, তাহলে আমরা বর্তমান যে ব্যবস্থা/সিস্টেম আছে, সেটার শুধুমাত্র একটা উপাদান হিসেবে বিবেচিত হবো, এর বেশি কিছুই না।
অর্থাৎ জ্ঞানের সাথে যেমন তাওহিদের সম্পর্ক, তেমনিভাবে সম্পর্ক রয়েছে আখলাক ও রাজনীতির। তাই প্রত্যেক্টি বিষয়ের সামারি হলো একটি অপরটির পরিপূরক।
আজকে আমরা সবাই মিলে যে কাজ করছি, যে মুক্তির স্বপ্ন নিয়ে জ্ঞানের আন্দোলন করছি, এসব অবশ্যই দুনিয়াকে উন্মোচন করার একটি দরজার মতো। কেননা ইসলামি সভ্যতার উত্তরসূরি হিসেবে আমরা মানুষকে একটা কিছু পেশ করতে বাধ্য, একটা কিছু দিতে বাধ্য। আমাদের রাজনীতিবিদগন, আলেমগন যে কোনো ভাবেই হোক এটা দুনিয়ার সামনে পেশ করতে বাধ্য এবং তা করতেই হবে। কেননা আমাদের কাছে তাওহিদ রয়েছে।
কিন্তু ইসলাম বর্তমান দুনিয়াকে কী বলে সেটা কি আমরা তুলে ধরতে পারছি?
দুঃখজনক হলেও খুব সত্য, বর্তমান দুনিয়া যে সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, এই সংকটে থাকার কারণে মুসলিম উম্মাহ এই সকল বিষয়ে চিন্তা করতে পারছে না বা বিশ্বকে কোনো কিছুই দিতে পারছে না। এ কারণে মুসলিম উম্মাহর একজন সদস্য হিসেবে ইসলামের যে ইজ্জত, সম্মান, মর্যাদা– এটা আমাদের পুনরায় বহন করতে হবে, বহন করার মতো যোগ্যতা অর্জন করতে এবং এ জন্য দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। বর্তমানে এই ইজ্জতের প্রতিফলন হচ্ছে আখলাক, আদালত, এমনকি মোরাফফাহ তথা সামাজিকভাবে মানুষের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বীতা। যেমন আমরা প্রত্যেকটা নামাযে বা দু’আয় পড়ি আমাদের আখিরাত এবং দুনিয়া উভয়েই যেন কল্যানময় হয়।
ইসলামের অন্যতম একটা গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষা হচ্ছে আধ্যাত্মিকতা। আধ্যাত্মিকতা বলতে কেউ কেউ এ রকম ভাবে যে, নামায পড়বো, দু’আ করবো, রোজা রাখবো, সাদকা করবো, আর এভাবে আমাদের আধ্যাত্মিকতা শক্তিশালী হবে। কিন্তু আমরা যারা ইসলামী আন্দোলনের কর্মী, তারা আমরা এভাবে বুঝি না। আমরা বুঝি আধ্যাত্মিকতা হচ্ছে একজন মানুষ যাই করুক না কেন, আখিরাতের কথা চিন্তা করে করা। একজন মানুষ সে জ্ঞান অর্জন করুক অথবা তার পরিবারকে পরিচালনা করার জন্য কাজ করুক, রাজনীতি করুক, যাই করুক না কেন সে যদি আখিরাতের কথা চিন্তা করে এ কাজ করে তাহলে সে সবচেয়ে সুন্দরভাবে এ কাজ করবে। মানুষের সাথে খারাপ আচরণ বা খারাপ ধারণা সে করতে পারবে না। কেননা আমাদের কাজের মূল চেতনা হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি। এই কারণে একই সাথে আমাদের দুনিয়া এবং আখিরাত দুইটাই জান্নাত হওয়া উচিত। কিন্তু আমাদের সীমাবদ্ধতার দরুণ আমরা এ দুনিয়ায় যা ইচ্ছা তাই করতে পারি না। আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন দুনিয়াকে আমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন এবং দুনিয়া বিনির্মাণ করার জন্য আমাদের পাঠিছেন। এই পূথিবীতে মানুষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিফাত বা গুনাবলীর একটা হলো ‘এ দুনিয়ার বিনির্মানকারী’।
এখন কথা হলো, একজন মানুষ যেটা জানে না, চিনে না, তা কি তার পক্ষে বিনির্মান করা সম্ভব? মোটেই সম্ভব না।
তাই শুরুতেই বলেছিলাম যে, এই কারণে মানুষ ওহী এবং কা’য়িনাত– এ দু’টোকে একসাথে করে একটা সঠিক কাজ করতে বাধ্য। যেমন কারো জ্ঞান আছে কিন্তু প্র্যাকটিকেলি কিছু নেই, তাহলে এই জ্ঞান কোনো কাজে নেই তথা কোনো উপকারেই আসবে না।
তেমনিভাবে কাজ আছে, কিন্তু কেন করছি তা জানি না, এটাও কোনো কাজে আসবে না। এ কারণে উস্তাদ নাজমুদ্দিন এরবাকান বলতেন, ইসলামে একটা গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষা হলো শু’উর বা চেতনা, জযবা। আর এই শু’উর বা এই চেতনা হচ্ছে সমগ্র মানবতার কল্যাণের জন্য কাজ করতে পারা, কাজ করা এবং এই লক্ষ্যে প্রচেষ্টা চালানো। এই কারণে আমাদের জ্ঞানকে জিহাদ দ্বারা সজ্জিত করতে হবে। নামায যদি দ্বীনের স্তম্ভ হয়, জিহাদ হলো এর সর্বোচ্চ চূড়া। তাই বর্তমানে আমরা আমাদের ওয়ার্ল্ড ভিউ হিসেবে, তাওহীদের প্রয়োজন হিসেবে, আমাদের দায়িত্ব হিসেবে দুনিয়াকে বিনির্মাণ করার জন্য কাজ করতে হবে। তিনটি প্রশ্নের জবাব খুব ভালোভাবে দিতে হবে।
এক. আমি কে?
দুই. আমরা কে?
তিন. তারা কে?
এই তিনটা প্রশ্নেরই জ্ঞানগত জবাব দিতে বাধ্য আমরা। তবে এ ক্ষেত্রে তথ্য যথেষ্ট নয়। এটাকে ইরফানের মাধ্যমে বিকশিত করতে হবে, প্রতিপালিত করতে হবে। আল্লাহ আমাদের বলেছেন, ‘আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি যাতে তোমরা একজন আরেকজনকে চিনতে পারো। উক্ত আয়াতে মুতা’আরিফি মানে তা’রুফ, তারুফ শব্দটা ইরফানকে ভাগাভাগি করার (শেয়ার করার) অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। মুসলমানগন যখন একসাথে হবে তখন একটা অর্থ সৃষ্টি হবে, অর্থবহ একটা বিষয় বের হয়ে আসবে। আর এই অর্থ বা অর্থবহ করা শুধুমাত্র ইরফানের মাধ্যমেই সম্ভব। আমরা যদি এ পৃথিবীকে বিনির্মান করতে চাই, তবে একজন আরেকজনকে ভাই হিসেবে চিনতে হবে। ভ্রাতৃত্ব কখনোই শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করে সম্ভব নয়।
ইরফান শুধুমাত্র একটা জাতি থেকে কখনোই উৎপত্তি হয় না। ইরফানের জন্য উম্মত হওয়া প্রয়োজন। ইরফান যদি একটা জাতির সাথে সম্পৃক্ত হয়, তবে তা হবে সংস্কৃতি। এটা শুধুমাত্র সেই সমাজে বা সেই জাতিতে যে আছে, তার জন্য একটা আইডেন্টিটি বা একটা পরিচয় বা সংস্কৃতির এর বেশি কিছু না। আমরা যদি আমাদের ইরফানকে একত্রিত বা পুঞ্জীভূত করতে পারি, তাহলে আমরা এ সমাজের বা জাতির যে বাউন্ডারি, তার উপরে গিয়ে চিন্তা করতে পারবো। আর ওই সময়েই আমাদের ভ্রাতৃত্ব পরিপূর্ণ অর্থে বুঝা যাবে। আজকে আমরা যদি ইসলামি সভ্যতার উপর ভিত্তি করে এই দুনিয়াকে সুন্দর করতে চাই, এই দুনিয়াকে নতুন করে সাজাতে চাই, তাহলে এটার কোনো বিকল্প নেই। তাওহীদ আমাদেরকে এ কথাই বলে।
কিন্তু যে জ্ঞান আমাদের মধ্যে বিভাজনের দেয়াল সৃষ্টি করে, পারস্পরিক সম্পর্ক ছিন্ন করে দেয়, সে জ্ঞানের কোনো মূল্য নেই। আরেকটা বিষয় হলো তাওহীদ যেমন আমরা উম্মত– এ কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, তেমনি আমরা যে মানুষ, আমরা যে ব্যক্তি এ কথাও স্মরণ করিয়ে দেয়। মানবতা থেকে দূরে থেকে কখনোই মুসলমান হওয়া সম্ভব নয়। সামগ্রিক অর্থে বা পরিপূর্ণ অর্থে ইসলাম আমাদেরকে মানবতার কল্যানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। মূলত মানুষ হিসেবে আত্মপ্রতিষ্ঠা করার নাম হচ্ছে মুসলমান হিসেবে আত্মপ্রতিষ্ঠা।
একটা বিষয় চিন্তা করি যদি, ছোট ছোট বাচ্চারা যখন খেলে, তখন কিন্তু তারা একে অপরকে বলে না, “তুমি সাদা, তোমাকে দেখতে ভালো দেখায় না, তুমি কালো, তুমি অমুক জায়গার, তুমি তমুক জায়গার”। এই বিভাজন তারা কখনোই করে না। তারা কোন জায়গায় একমত? একটা খেলা আছে, এটা সবাই মিলে খেলবে। একইভাবে পার্থক্য ভুলে আমরাও ভিশনকে সামনে রেখে মানুষ মানুষের জন্য কাজ করে যাওয়ার কথা ছিল। এসব উত্তম আখলাকের ক্রাইটেরিয়া হিসেবে বিদায় হজ্জের ভাষণেও তুলে ধরা হয়েছে।
আমরা একটা বিষয় চিন্তা করি যে, আপনি কিছুক্ষণ পর মারা যাবেন, আপনার একটা উম্মাত আছে, আপনি তাদেরকে কী বলে যাবেন? নামায পড়ো, রোজা রাখো, হজ্জ করো- এগুলো অর্থাৎ আপনার সাথে সম্পৃক্ত বিষয়গুলো বলবেন নাকি সমগ্র বিশ্ব মানবতার সাথে সম্পৃক্ত বিষয়গুলো বলবেন? অবশ্যই সমগ্র বিশ্ব মানবতাকে সম্পৃক্তকারী, বিশ্ব মানবতার সাথে সম্পৃক্ত বিষয়সমূহের কথা তাদের বলবেন। এখন একটু খেয়াল করলেই দেখবো যে, বিদায় হজ্জের ভাষণে কী কী বলা হয়েছে।
তা হল, মানুষ এবং মানবতার কল্যাণ ,আর এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় ফজিলতসম্পন্ন কাজ।
এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয়, বিদায় হজ্জের ভাষণে উপস্থিত সবাই ছিলেন মুসলমান, হজ্জ করতে এসেছিলেন, কিন্তু ওখানে রাসূল (সাঃ) ‘আইয়্যুহান নাস’ বা ‘হে মানব জাতি’ বলে সম্বোধন করছেন। আর তিনি যে সকল বিষয়ে জোর দিয়েছেন তার প্রত্যেকটা বিশ্ব মানবতার সাথে এবং সিস্টেমের সাথে সম্পৃক্ত, একটাও ব্যক্তিগত বা সমাজের সাথে সম্পৃক্ত নয়।
যেমন প্রথম কথা– তোমরা কেউ কারো চাইতে শ্রেষ্ঠ নও, সবাই সমান। কোন মাজহাব, কোন জাতি, কোন ধর্ম, কোনো বিভেদ নেই। একজন আরেকজনকে হত্যা করো না। এই দুনিয়ার সবচেয়ে সর্বশ্রেষ্ঠ বা সবচেয়ে মূল্যবান হচ্ছে মানুষের প্রাণ। তোমাদের বংশকে রক্ষা করো। যিনা করো না। তাওহীদকে মূল ভিত্তি হিসেবে ধরো।
আজ আমরা যে সিস্টেমের মধ্যে বসবাস করি, এটা শিরকে পরিপূর্ণ। তাওহীদের পন্থাকে, তাওহীদের পদ্ধতিকে বা সিস্টেমকে পুনরায় আমাদের প্রতিস্থাপন করতে হবে, বিনির্মাণ করতে হবে।
বিদায় হজ্জের ভাষণে ১৫ টার মতো ধারা আছে। এগুলোর প্রত্যেকটা হচ্ছে আমাদের জন্য কুল্লি আসাস বা সামগ্রিক মূলনীতি। এ সকল মূলনীতিকে অবহেলাকারী একটা ব্যবস্থা কখনো বিশ্ব মানবতার জন্য কল্যান বয়ে আনতে পারে না।
আমি একটা বুঝি, সে একটা বুঝে, আমেরিকান কেউ একটা কিছু বুঝে, আফ্রিকার কেউ একটা কিছু বুঝে; তবে সত্যিকার বিষয়টি কীভাবে আসবে? সত্যিকারের অর্থ বা সত্যিকারের বিষয়টা মুতা’আরিফের মাধ্যমে মানে পারস্পরিক ইরফানের মাধ্যমে আসবে বা তৈরী হবে। এ কারণে আমাদেরকে একসাথে একত্রিত হয়ে এ সকল বিষয় নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। উস্তাদ নাজমুদ্দিন এরবাকান মুতা’আরিফেকে, গ্লোবাল সিস্টেমকে দাঁড় করানোর জন্য একটা সিস্টেমের প্রস্তাবনা দিয়েছেন।
বিশ্ব মানবতা হিসেবে অর্থের সঙ্কট, ক্রাইসিস অব আন্ডারস্ট্যান্ডিংকে সমাধান করার জন্য আমাদের একসাথে কাজ করার কোনো বিকল্প নেই। এই গ্লোবাল প্রতিষ্ঠানসমূহ আমাদের চিন্তাকে, আমাদের উপলব্ধিকে বিকাশ করবে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে। একইসাথে এটাও মনে রাখতে হবে, একটা সিস্টেমের আখলাক গঠন করার ক্ষেত্রে আমাদেরকে একটা প্রস্তাবনা দেয়। বর্তমানে মুসলিম বিশ্বে ব্যক্তিগত এবং সামাজিক আখলাক আছে, কিন্তু সিস্টেমের আখলাক বা ব্যবস্থাপনার আখলাক না থাকার কারণে আমরা কোনো ভূমিকা পালন করতে পারছি না, বিশ্বজনীন কোনো সংকটকে সমাধান করার ক্ষেত্রে আমরা কোনো ভূমিকাই পালন করতে সক্ষম হচ্ছি না।
আমরা সকলে মিলে যে কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছি, এর মাধ্যমে মূলত মানুষের জন্য এ ফায়াদা বা উপকারকে মেক্সিমাইজ করার কোনই বিকল্প নেই। আর এসকল কাজ একই সাথে একটা চেতনা বা জযবা সৃষ্টি করা ও উপলব্ধি সৃষ্টি করার অন্যতম পদক্ষেপ। আমরা যদি জযবাসম্পন্ন বা চেতনাসম্পন্ন না হই, তাহলে আমরা আমাদের নিজেদের সমস্যারই কোনো সমাধান করতে পারবো না। একই সাথে আমরা যে কাজগুলো করছি, সেগুলো সকলের জন্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ।
আলহামদুলিল্লাহ আজ আমরা এ পৃথিবীকে নতুন করে বিনির্মাণ করার জন্য কোন কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে তা নিয়ে কথা বলছি। এটা অনেক বড় একটা বিষয়। তাই আমরা যে কাজ করছি তাকে বিশ্ব মানবতার পর্যায়ে উত্তীর্ণ করতে হবে, এটাকে স্থানীয়ভাবে রাখলে চলবে না। যে শুধুমাত্র নিজের কথা চিন্তা করে, নিজের পরিবারের কথা চিন্তা করে সে কখনোই বিশ্ব মানবতার জন্য কোনো কল্যান বয়ে আনা বা কোনো কিছু করতে পারবে না। যেমন এভাবে চিন্তা করা যায়– আমরা খাবার না খেয়ে কি বাঁচতে পারবো? পারবো না। আমরা সবাই এক রুমে বসে যদি এখন একটা খাবার খাই, আর হঠাৎ পাশের রুমে যদি আগুন লাগে, তখন কি আমরা এ কথা বলতে পারবো যে, যেহেতু খাওয়া ছাড়া বাঁচতে পারবো না, তাই আগে খাই, তারপর আগুন নেভাবো? অবশ্যই বলা সম্ভব নয়। একই সাথে আমাদেরকে আগুনকে নেভাতে পারবো এ রকম চিন্তা এমনকি শতাব্দী বা যুগের যে সমস্যা এটাকে সমাধান করার জন্য একটা ধারণা একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং ডেভেলপ করতে হবে। বর্তমান মুসলিম উম্মাহর অবস্থা এমন– সবাই যার যার রুমে একটা করে নিজেদের মতো দুনিয়া প্রতিষ্ঠিত করে নিয়েছে। সবাই তার নিজের রুম নিয়ে চিন্তা করছে। কিন্তু গোটা বিল্ডিংয়ে আগুন লেগেছে। ঘরের উত্তরপাশে আগুন, কিন্তু সে দক্ষিণ পাশে তাকিয়ে বলছে, “কই, আমি তো আগুন দেখি না!” মূলত তাওহীদ না থাকার কারণেই। তাই আমরা অবশ্যই আমাদের রুমের কথা চিন্তা করবো, তার পাশাপাশি আমাদের যে অ্যাপার্টমেন্ট মানে আমাদের উম্মাত- তার চিন্তাও করবো, তারপর গোটা বিল্ডিং তথা সমগ্র মানবতার কথা চিন্তা করবো।
আমরা আজকে যে জ্ঞানের কাজ করছি তা যেন একটা ওয়ার্ল্ড ভিউ দাঁড় করায়, এটা যেন ওয়ার্ল্ড ভিউ গ্রো করে আমাদের মূলনীতিতে। যা আমাদের চিন্তা জগতে একটা সিস্টেমের আখলাক সৃষ্টি করতে বাধ্য। আমরা যদি উপরোক্ত পর্যালোচনার আলোক এসকল কাজ করতে পারি, তবে আল্লাহর সৃষ্ট এ দুনিয়ায় অবশ্যই আল্লাহ প্রেরিত একটা চেতনা-সম্পন্ন সভ্যতা হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পারবো, ইনশাআল্লাহ।
-মুহসিনা বিনতি মুসলিম