শিউলিমালা একাডেমি

চেং হো: যিনি কলম্বাসের আগে আমেরিকা আবিষ্কার করেন

মার্কো পোলো, ফার্ডিন্যান্ড ম্যাগেলান, ভাস্কো দা গামা, কলম্বাস এবং অন্যান্য পশ্চিমা অভিযাত্রী, যারা মহাসাগর এবং সমুদ্র অনুসন্ধানের ইতিহাসে নিজেদের নাম লিখিয়েছেন, তাদেরকে আমরা সবাই চিনি। আমি যখন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একটি ছোট মেয়ে ছিলাম, তখন আমার শিক্ষকরা আমাকে ‘গ্রেট পশ্চিম ও বিশ্ব সভ্যতা’ গঠনে তাদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান এবং অংশগ্রহণ সম্পর্কে বলতেন। তারা আমাদের মার্কো পোলোর চীন অভিযান, ভাস্কো দা গামার আফ্রিকার উত্তমাশা অন্তরীপের (কেপ অফ গুড হোপ) মধ্য দিয়ে ইউরোপ থেকে ভারতে সমুদ্রপথ আবিষ্কারের সাফল্য, কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার ইত্যাদি সম্পর্কে শিখাতেন। তবে, তারা আমাদের কখনো প্রাচ্যের অভিযাত্রীদের সম্পর্কে বলেননি, যারা পাশ্চাত্যের অভিযাত্রীদের আগে সমুদ্র অভিযানে ইতিহাস রচনা করেছিলেন।

আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের আগ পর্যন্ত ইবনে বতুতা, ইবনে মাজিদ, শামসুদ্দিন আবু আবদুল্লাহ আল-মুকাদ্দাসী, ইবনে ফাদলান, ইবনে জুবায়ের, দ্বিতীয় আবু বকর (মালির রাজা), পিরি রেইস এবং আরও অনেক মুসলিম অন্বেষণাকারীর নাম জানতামই না এবং বিশ্ব সভ্যতায় ইসলাম কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল (এবং এখনও আছে) তাও অনুধাবন করতে পারিনি। মূলত, আমি আমাদের ইসলামী সভ্যতার সৌন্দর্য এবং ঐশ্বর্য খুঁজে পেয়েছি এসব ইসলামিক ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে যারা তাদের নিজ নিজ অঙ্গনে ইতিহাস রচনা করেছেন এবং স্বীয় কর্মের পদচিহ্ন রেখে গিয়েছেন। ইসলাম গ্রহণকারী প্রতিটি নৃ-গোষ্ঠী ও জাতিগোষ্ঠী একটি মহান ইসলামী সভ্যতা গঠনে অবদান রেখেছেন।

প্রাচ্যের সমুদ্র ভ্রমণকারী ও অনুসন্ধানকারীদের মধ্যে যে ব্যক্তিত্ব আমাকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করেছিলেন তিনি হলেন মুসলিম নৌ সেনাপতি, চেং হো। ‘চেং হো’ সেই ব্যক্তি, যিনি কলম্বাসের আগে আমেরিকা আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি চতুর্দশ শতাব্দীর শেষের দিকে চীনের ইউনান অঞ্চলের একটি ছোট্ট শহরে, হুই নামক পরিবারে (চীনা মুসলিম নৃগোষ্ঠী) জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মগত নাম ছিল ‘মা হো’। চীনে ‘মুহাম্মদ’ এর সংক্ষিপ্ত নাম হিসাবে ‘মা’ ব্যবহার করা হয়। তার পরিবারের দাবি, তারা ইউনানে মঙ্গোলিয়ান গভর্নরের বা বুখারার রাজা মোহাম্মদের বংশধর।

একজন মুসলিম হিসাবে বেড়ে ওঠায় ‘মা হো’ শৈশব থেকেই ইসলাম শিক্ষায় দ্বীক্ষিত হতে থাকেন এবং অল্প বয়সেই কুরআন মুখস্থ করেন। পড়াশোনার ক্ষেত্রে তার বাবা এবং দাদার অবদান ছিল অনেক। ‘মা হো’ -এর দাদা এবং বাবা মক্কায় হজ সম্পন্ন করতে গিয়েছিলেন এবং তাদের উৎসাহেই তার মাঝে বহির্বিশ্ব সম্পর্কে জানার আগ্রহ জন্মে। তাদের ভ্রমণ অভিজ্ঞতা গুলো ‘মা হো’ এর লেখাপড়ায় বেশ অবদান রাখে। ‘মা হো’ এমন এক পরিবারে বেড়ে ওঠেন যেখানে তিনি আরবি ও চীনা, দুটো ভাষাতেই অনর্গল কথা বলতে পারতেন । অর্থাৎ, দুটো ভাষাই ছিল তার মাতৃভাষা।

ভৌগোলিকভাবে যেসব দেশ চীনের পশ্চিমে অবস্থিত সেসব দেশগুলো সম্পর্কে ‘মা হো’ জানতে আগ্রহী ছিলেন। তিনি তাদের ভাষা, ধর্ম, ঐতিহ্য, ইতিহাস এবং ভূগোল অধ্যয়ন করেন।

‘মা হো’-এর বয়স যখন দশ বছর, ইউনানায় মিং রাজবংশের সেনাবাহিনী তাদের সামরিক অভিযানের সময় তাকে ধরে নিয়ে যায়। তারা তাকে নানজিংয়ে নিয়ে যায় এবং সেখানে তিনি তার সামরিক প্রশিক্ষণ নেন। পরবর্তীতে, তাকে ইয়ান রাজপুত্র এবং মিং রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাটের চতুর্থ পুত্র ‘চু ডি’ এর সেবার জন্য বেইজিংয়ে পাঠানো হয়। তার দক্ষতা, আনুগত্য, সততা, নিষ্ঠা এবং প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে, ‘মা হো’ যুবরাজের সেরা বন্ধু এবং ব্যক্তিগত দেহরক্ষীতে পরিণত হন। এ সময়ই ‘মা হো’ -এর বুদ্ধি, প্রজ্ঞা এবং নেতৃত্বের দক্ষতা দৃশ্যমান হতে থাকে। ৪ বছর ধরে যুবরাজ ‘চু ডি’-এর পক্ষে বিভিন্ন অভিযান ও লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেওয়ার মাধ্যমে ‘মা হো’ চীনের সর্বাধিক শক্তিশালী সামরিক সেনাপতিতে পরিণত হন।

যুবরাজ ‘চু ডি’ যখন মিং রাজবংশের নতুন সম্রাট হন, তিনি সিদ্ধান্ত নেন, যেসমস্ত কর্মকর্তা এবং আমলারা তাকে সমর্থন করেছিলেন তাদের তিনি পুরস্কৃত করবেন। ‘মা হো’ ছিলেন সেই পুরস্কৃত হওয়া ব্যক্তিদের একজন। ১৪০৪ সালে, নতুন সম্রাট তাকে “রাজ পরিবারের সর্বোচ্চ সেনাপতি” হিসাবে ভূষিত করেন। যুবরাজ চু ডি ‘মা হো’ এর নাম পরিবর্তন করে নতুন উপাধি দেন ‘চেং’। এটি ছিল রাজকীয় সম্মানের প্রতীক এবং ‘মা হো’ এর সমস্ত কাজের জন্য ‘চু ডি’ এর পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানানোর পন্থা। তখন থেকে ‘মা হো’ হয়ে যান ‘চেং হো’।

‘চু ডি’-এর সাথে ‘চেং হো’ এর যেসমস্ত রাজনৈতিক আলোচনা হয়েছিল, তিনি যেসব সামরিক জ্ঞান অর্জন করেছিলেন, বিজ্ঞ মানুষের সাথে তার যোগাযোগ, বণিকদের সাথে বাণিজ্য এবং শৈশবে তিনি যে সমস্ত দক্ষতা অর্জন করেছিলেন, তা তার জন্য বিশ্ব অন্বেষণ করার এক নতুন দ্বার ও দিগন্ত উন্মোচণ করে দেয়। পশ্চিমের দিকে বড় বড় সমুদ্রযাত্রার জন্য সম্রাট তাকেই আদর্শ সেনাপতি হিসেবে নির্বাচন করেন। চীনের সর্বাধিক ক্ষমতাশালী সেনাপতি হওয়ার পরে ‘চেং হো’ চীনের শ্রেষ্ঠ সমুদ্র অভিযাত্রী হন।


‘নৌ-সেনাপ্রধান চেং হো’ হয়ে যায় তার নতুন উপাধি। চু ডি ‘চেং হো’-কে সমুদ্রবিষয়ক সমস্ত কাজের দায়িত্ব দেন। অভিযাত্রী হিসাবে তার মিশন শুরু করার পূর্বে ‘চেং হো’ খুব যত্ন সহকারে সবকিছু প্রস্তুত করেন। তিনি বিদ্যমান নৌ চার্ট, অ্যাস্ট্রো নেভিগেশন, পূর্ব ও পশ্চিমা ক্যালেন্ডার, জ্যোতির্বিজ্ঞান, ভূগোল, সামুদ্রিক বিজ্ঞান, জাহাজ নির্মাণ, মেরামত এবং পরিচালনা সম্পর্কে বিশদ অধ্যয়ন করেন।

১৪০৫ থেকে ১৪৩৩ সাল পর্যন্ত ‘চেং হো’ মোট ৭টি দুর্দান্ত সমুদ্রযাত্রা অভিযানের নেতৃত্ব দেন। তিনি বেশ কয়েকবার মহাসাগর এবং সমুদ্র অতিক্রম করেন। দক্ষিণ চীন সাগর থেকে আফ্রিকার পূর্ব উপকূল, ভারত মহাসাগর পেরিয়ে পারস্য উপসাগর এবং লোহিত সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল তার সমুদ্রযাত্রা। তিনি ৩০টিরও বেশি এশিয়ান এবং আফ্রিকান দেশ পরিদর্শন করেন এবং তাদের সংস্কৃতি এবং বিশ্বাস সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারেন। এ সময় তিনি মক্কায় হজ্বও সম্পন্ন করেন। এই সমুদ্র অভিযানে তিনিই একমাত্র মুসলিম ছিলেন, এমন নয়। ‘মা হুয়ান’ এর মতো আরও অনেক ভ্রমণ উপদেষ্টা এবং অনুবাদকগণও ‘চেং হো’ এর ন্যায় চীনা মুসলিম ছিলেন।

‘চেং হো’ এর নেতৃত্বে প্রথম নৌবহরে নাবিক, কেরানি, দোভাষী, সৈনিক, কারিগর, চিকিৎসক এবং আবহাওয়াবিদ সহ ৩২৭ টি জাহাজে ২৭,৮৭০ জন লোককে শামিল করা হয়েছিল। তিনি ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন, জাভা এবং সুমাত্রা গিয়েছিলেন। ‘চেং হো’ যে জাহাজগুলোর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সেগুলো ৪৪০ ফুট (১৩৭.২ মিটার) লম্বা এবং প্রস্থে ১৮৬ ফুট এর অধিক। এ জাহাজগুলো সহস্রাধিক যাত্রী বহন করতে সক্ষম ছিল। পাশাপাশি চীনামাটির বাসন, সোনার এবং রৌপ্যের পাত্র, তুলা, তামা এবং সিল্কের জিনিসসহ প্রচুর পরিমাণে পণ্যসম্ভার বহন করতেও সক্ষম ছিল। কলম্বাসের আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দেয়া জাহাজ এবং ইতিহাসে নথিভুক্ত যেকোন কাঠের জাহাজের তুলনায় ‘চেং হো’ এর জাহাজগুলো ছিল অনেক গুন বড়।

‘চেং হো’-এর সবচেয়ে দর্শনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রযাত্রা ছিল তার চতুর্থ ভ্রমণ যেখানে তিনি ৩০,০০০ মানুষকে সাথে হরমুজ প্রণালী, আদেন এবং লোহিত সাগর অতিক্রম করে আরবে পৌঁছান এবং ১৯ টি দেশের রাষ্ট্রদূত সম্রাট ‘চু ডি’-র জন্য উপহার নিয়ে তার জাহাজে আসেন।

আরব সফর শেষে তিনি আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে ভ্রমণ করেন এবং অনুমান করা হয় তিনি মোজাম্বিকেও পৌঁছান।

‘চেং হো’ যতবারই কোনও দেশে গিয়েছেন, প্রতিবারই হাতির দাঁত, উট, স্বর্ণের মতো বিদেশী পণ্য নিয়ে চীনে ফিরতেন।

১৪২৪ সালে সম্রাট ‘চু ডি’ মারা যাওয়ার পরে, নতুন সম্রাট (হংজি) তাৎক্ষণিকভাবে সমস্ত সামুদ্রিক যাত্রা বন্ধ করে দেন। পরবর্তী ১০০ বছরে চীন একটি স্ব-বিচ্ছিন্ন দেশে পরিণত হয়। ‘চেং হো’ নানকিং-এ বন্দর কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত হন এবং তার সেনাবাহিনী ভেঙে দেওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। পরবর্তীতে ‘চেং হো’ জুয়ান্ডের সহায়তার তার সমুদ্র অভিযান পুনরারম্ভ করেন।

১৪৩৩ সালে, ৬০ বছর বয়সে ‘চেং হো’ তার ৭ম এবং শেষ যাত্রায় পারস্য উপসাগর, লোহিত সাগর ও আফ্রিকা পুনরায় পরিদর্শন করেন এবং ফেরার পথে ভারতে তার মৃত্যু হয়।

এটা প্রমাণিত যে, ‘চেং হো’ কলম্বাসের আগে আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়া আবিষ্কার করেন এবং তিনি আফ্রিকার পূর্ব উপকূলেও পৌঁছান এবং মার্কো পোলোর আগে কেপ অফ গুড হোপ (উত্তমাশা অন্তরীপ) থেকে কেপ ভার্দে দ্বীপপুঞ্জে যাত্রা করেন।

এই সমস্ত অভিযান বিশ্বকে একটি বার্তা পাঠিয়েছিল এবং তা হলো, চীন একটি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরাশক্তি। তবে ‘চেং হো’ তার ভ্রমণের মাধ্যমে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য সাধন করতে চেয়েছিলেন আর তা হলো মানুষকে ইসলামের দিকে আহ্বান করা।

তিনি তার মুসলিম পরামর্শদাতাদের সাথে নিয়ে যেখানেই ভ্রমণ করতেন সেখানকার স্থাণীয়দেরকে ইসলাম গ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানাতেন। ফলশ্রুতিতে দেখা যায়, জাভা, সুমাত্রা, বোর্নিও এবং অন্যান্য ইন্দোনেশীয় দ্বীপগুলিতে ‘চেং হো’ এর আগমনের পূর্বেই ছোট ছোট মুসলিম বসতি স্থাপিত হয়ে যায়। আরব ও ভারতীয় ব্যবসায়ীদের বদৌলতে কয়েক শতাব্দী আগে থেকেই দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ইসলামের বার্তা প্রচারের সূচনা হয়েছিল। পরবর্তীতে ‘চেং হো’ এই অঞ্চলে ইসলামের ক্রমাগত বিকাশে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় দ্রুত ইসলাম প্রচারের সুবিধার্থে ‘চেং হো’ পালেমবাং, জাভা, মালয়েশিয়ার উপদ্বীপ এবং ফিলিপাইনে চীনা মুসলিম সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাদের কাজ ছিল মসজিদ নির্মাণ এবং স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রয়োজনীয় অন্যান্য সামাজিক সেবা প্রদানের মাধ্যমে পুরো অঞ্চল জুড়ে ইসলাম প্রচার করা।

তার মৃত্যুর পর, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীনা মুসলিমরা বিভিন্নভাবে ‘চেং হো’ এর কাজ চালিয়ে যান। এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আরও বেশি লোককে ইসলামের দিকে নিয়ে আসে এবং ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন এবং এই পুরো দক্ষিণ পূর্ব এশীয় অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান মুসলিম সম্প্রদায়কে একটি শক্তিশালী সম্প্রদায়ে রূপান্তর করে।


উপসংহার: চীনের বৃহত্তম সমুদ্র অন্বেষণকারী ‘চেং হো’ কেবল চীনা ইতিহাসেরই গর্ব নন, আমাদের ইসলামী সভ্যতার ইতিহাসেরও এক অনন্য নায়ক তিনি।
আমাদের উচিত হবে না, এসব মহান বীরদের ভুলে যাওয়া!

সংকলক: জান্নাত আরা তাবাসসুম

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *