শিউলিমালা একাডেমি

“গৌরবোজ্জ্বল অতীত ও আত্মপরিচয়ের সংকটে দোদুল্যমান মুসলিম মানস”

আমরা জাতিগতভাবে মুসলিম। তবে নিজেকে একজন প্র্যাকটিসিং মুসলিম দাবি করা আমাদের মুখের বুলি মাত্র। শুধু নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আর মাঝে মাঝে কিছু নফল রোজা করে প্র্যাকটিসিং মুসলিম হওয়া যায় না। আমার মতো করে যদি বলি, ইসলাম একটি জীবনব্যবস্থা। যারা ইসলামের অনুসারী, তারা মুসলিম। যারা মুসলমানদের সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য চর্চা করে প্রকৃতপক্ষে, তারাই প্র্যাকটিসিং মুসলিম হওয়ার দাবীদার।

আজ আমরা বিজ্ঞান, গবেষণা ও দর্শন নির্ভর কোনো কথা বলতেই বুঝি সক্রেটিস, এরিস্টটল, প্লেটোর গবেষণা তত্ত্ব। কিন্তু আমরা জানি না আমাদের মুসলমানদের ইতিহাস। কতই আক্ষেপ ও বিস্ময়ের ব্যাপার! আজ যখন বিশ্বের সকল জাতি নিজেদেরকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরার প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত, তখনও সর্বাধিক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস-ঐতিহ্যের অধিকারী মুসলমানগন নিজেদের ইতিহাস সম্পর্কে উদাসীন ও নীরব। আমরা এমন ঐতিহাসিক জাতি, যে জাতির সৃষ্টিকর্ম, জ্ঞানচর্চা ও গবেষণা অনুসরণ করে ভিন্ন জাতির, ভিন্ন নীতির লোকেরা গবেষণা করে। শুধুমাত্র ওরিয়েন্টালিস্টদের জ্ঞানের ধারা পর্যালোচনা করলেই বিষয়টি আমাদের সামনে দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে যায়। জ্ঞানের শাখাগুলো যদি পর্যবেক্ষণ করি, আমরা সেখানে পাবো, চিকিৎসাবিদ্যা, গণিতশাস্ত্র, রসায়ন শাস্ত্র, পদার্থবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা, জীববিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান, নিউরোলজি, মনোবিজ্ঞান, ভূগোল, দর্শন, অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ইত্যাদি। এ প্রতিটি ক্ষেত্রের সূচনা থেকে উৎকর্ষ অব্দি এবং বর্তমান সময়েও মুসলমানদের অবদান আমরা কতটুকুই বা জানি?
আমরা কি জানি হাসান ইবনে হায়সামের নাম? ১১শ শতাব্দীর একজন ইরাকি বিজ্ঞানী হাসান ইবনে হায়সাম। অপটিক্স এর জনক ও পরীক্ষামূলক পদার্থবিদ্যা এবং ‘প্রথম বিজ্ঞানী’ বিবেচনা করা হয় যাকে। কেরিম কেরিমো, সোভিয়েত স্পেস প্রোগ্রাম এর প্রতিষ্ঠাতা, প্রথম মানব স্পেসফ্লাইট ভস্টক ১ এর পিছনের একজন মূল কারিগর, এবং প্রথম স্পেস স্টেশন এর প্রধান স্থপতি।
এভাবে রয়েছে সংখ্যাতীত উদাহরণ। এসব ক্ষেত্রে অবদান রাখা ব্যক্তিদের সম্পর্কে আলোচনা করা যাক–

জীববিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান, নিউরোলজি ও সমাজ বিজ্ঞানঃ নোবেল পুরস্কার বিজয়ী প্রথম মুসলিম আজিজ সানজার, যিনি mechanistic studies of DNA repair এর জন্য এ পুরস্কার পেয়েছিলেন। আব্দুল ইবনে আহম্মেদ ছিলেন স্পেনের তথা মুসলিম জাহানের সর্বশ্রেষ্ঠ উদ্ভিদ তত্ত্ববিদ। সাইকোথেরাপি ও সংগীত থেরাপির অগ্রদূত আল কিন্দি, সামাজবিজ্ঞানী এবং চেতনার অগ্রদূত আল ফারাবী, নিরক্ষীয় মনোবিজ্ঞান সাইকোফিজিক্স ঘটনাবলী এবং ভিজ্যুয়াল ধারণার প্রতিষ্ঠাতা হাসান ইবনে হায়সাম। চিন্তা পরীক্ষা, আত্মসচেতনতা এবং আত্মোপলব্ধির অগ্রদূত ইবনে সিনা, স্নায়ুবিজ্ঞান এবং নিউরোফার্মাকোলজির অগ্রদূত ইবনে যুহর, পারকিনসন রোগের প্রতিষেধকের অগ্রদূত আন্দালুসিয়ার প্রধান বিচারপতি ইবনে রুশদ, ইরানের আহমাদ রেজা দেফর প্রমুখ।

জ্যোতির্বিদ্যাঃ রাযযাক ইবনে গিলানী, আলী কুশজি, আহমদ খানি, ইবরাহীম আল ফাজারী, আল খাওয়ারেজমী, আবু মা’শার আল বালখী, আল ফারগানি, নাসির আদ-দীন তুসি, বনু মুসা, আবু হানিফা আল দিনাওয়ারী, আল মাজরিতি, আল বাত্তানী, আল ফারাবী, ওমর খৈয়াম, হাসান ইবনে হায়সাম প্রমুখ। স্পেনে মুসলিম খেলাফতের সময় মুসলমানগণ বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিভাগ, বিশেষ করে জ্যোতিষশাস্ত্র ও চিকিৎসাবিজ্ঞানে আশানুরূপ উন্নতি সাধন করে। স্পেনের আন্দালুসিয়ায় জ্যোতির্বিজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধিত হয়েছিলো। স্পেনের অধিকাংশ জ্যোতির্বিদ বিশ্বাস করতেন যে, মানুষের জন্ম ও মৃত্যুর মধ্যবর্তী ঘটনাবলী বহুলাংশে নাক্ষত্রিক প্রভাবে ঘটে থাকে। এ সময় জ্যোতির্বিদগণ এর মধ্যে প্রখ্যাত ছিলেন কর্ডোভার আল মাজরিত, টলেডোর আল জারকালী এবং সেভিলের ইবনে আফলাহ। মুসলমানদের দ্রাঘিমা এবং অক্ষরেখা সংক্রান্ত সারণী ইউরোপে সমাদৃত ছিলো। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো পৃথিবীর কেন্দ্রচূড়া সম্পর্কে ধারণা। কলম্বাস এসব সূত্র থেকেই জানতে পারেন পৃথিবী একটি নাসপাতির মতো এবং পূর্ব গোলার্ধের অরিণের ঠিক উল্টোদিকে পশ্চিম গোলার্ধেরও একটি চূড়া রয়েছে। এভাবে মুসলমানদের পৃথিবীর কেন্দ্রীয় চুড়ার ধারণা নতুন পৃথিবী অর্থাৎ আমেরিকা আবিষ্কার করতে সহায়তা করেছিলো।

রসায়ন শাস্ত্রঃ রসায়ন শাস্ত্রের জনক জাবির ইবনে হাইয়ান। এছাড়াও রয়েছেন জাফর আল সাদিক, আল কিন্দি, আল বিরুনী, ইবনে সিনা, ইবনে খালদুন, নাসির উদ্দীন তুসি। রয়েছেন ১৯৯৯ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মিশরীয় রসায়নবিদ আহমেদ এইচ জেইয়েল।

ভূগোলঃ ঐতিহাসিক ভূগোলের অগ্রদূত এবং আরবের হেরাডোটাস খ্যাত আল মাসুদী। পরিবেশ বিজ্ঞানে আল কিন্দি। ভূ-গণিতের জনক, সাংস্কৃতিক ইতিহাস এবং প্রথম ভূতত্ত্ববীদ ও নৃ বিজ্ঞানী আল বিরুনী। ইবনে সিনা, ইবনে রুশদ, ইবনে বতুতা, ইবনে আন নাফিস প্রমুখ।

গণিতঃ আল কিন্দি, ওমর খৈয়াম, নাসির উদ্দীন আল তুসি, আল ফারাবী, আল বাত্তানী, বনু মুসা, আল বিরুনী, আল-গাজালী প্রমুখ।


দর্শনঃ আল কিন্দি, ইবনে রুশদ, ইবনে খালদুন,আল ফারাবী, ইবনে আরাবী, রুমি, ইবনে সিনা, আল্লামা ইকবাল, নাসির উদ্দীন তুসি প্রমুখ।

পদার্থবিজ্ঞানঃ আল বিরুনি, জাফর আল সাদেক, বনু মুসা, হাসান ইবনে হায়সাম, ইবনে সিনা, ইবনে রুশদ,নাসির উদ্দিন তুসি। বিশ শতকের বাংলাদেশী স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার, স্কাইস্ক্র্যাপার বিল্ডিং থিওরীর ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের উন্মোচনকারী ফজলুর রহমান খান। ১৯৭৯ সালে নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী পাকিস্তানী পদার্থবিজ্ঞানী আবদুস সালাম। ভারতীয় আণবিক প্রকৌশলী, পরমানু বিজ্ঞানী এবং ১১ তম রাষ্ট্রপতি এপিজে আব্দুল কালাম।

চিকিৎসা শাস্ত্রঃ ইবনে সিনা। তার বিখ্যাত গ্রন্থ “আল কানুন”কে চিকিৎসাশাস্ত্রের বাইবেল বলা হয়। সার্জারি চিকিৎসার ক্ষেত্রে মুসলিম বিজ্ঞানীদের অবদান অপরিসীম। আনুমানিক ১০০০ সালের দিকে বিশ্বনন্দিত সার্জারি চিকিৎসক ছিলেন আল জাহরাত্তয়ি। তিনি সার্জারির ওপর প্রায় পনেরোশো পৃষ্ঠার একটি গ্রন্থ রচনা করেন। তিনিই সর্বপ্রথম সিজার অপারেশন করেছিলেন এবং অপারেশনের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত ফরসেপ বা চিমটা জাতীয় অস্ত্র উদ্ভাবন করেন। মুসলিম চিকিৎসাবিদদের মধ্যে আবু বকর মুহাম্মদ বিন জাকারিয়া আর-রাজি মানুষের কিডনি ও গলব্লাডারে কেন পাথর হয় সে সম্পর্কে একটি মৌলিক তথ্যপূর্ণ বই লিখেছেন। শবদেহ কাটার বিষয়ে তিনি লিপিবদ্ধ করেন “আল জুদারি ওয়াল হাসবাহ”। এটি লাতিন ও ইউরোপের সব ভাষায় অনুবাদ করা হয়। তার সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান হলো “আল হাবি”। এতে সব ধরনের রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও চিকিৎসাশাস্ত্রে মৌলিক গবেষণায় অভাবনীয় অবদান রাখেন প্রসিদ্ধ কয়েকজন মুসলিম মনীষী। তাদের মধ্যে হাসান ইবনে হায়সাম, আল বিরুনি, আলী ইবনে রাব্বান, হুনাইন ইবনে ইসহাক, আবুল কাসেম জাহরাবি, জুহান্না বিন মাসওয়াই, সিনান বিন সাবিত, সাবিত ইবনে কুরা, জাবির ইবনে হাইয়ান প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।

অর্থনীতিঃ হানাফি মাজহাবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম আবু হানিফার শিষ্য আবু ইউসুফ (রহ.)। তিনি ছিলেন বাগদাদের প্রধান বিচারপতি। তৎকালীন খলিফার অনুরোধে তিনি রচনা করেন “কিতাব আল খারাজ”, যাতে তিনি রাজস্ব সংগ্রহ, আয়ের ব্যবস্থাপনা এবং সরকারি ব্যয় নিয়ে আলোচনা করেন। আবু ইউসুফ (রহ.) অ্যাডাম স্মিথের অনেক আগে রাজস্ব আরোপের নীতিমালা আলোচনা করেন। দেশের অর্থনৈতিক কী কী দায়িত্ব রয়েছে, তা নিয়েও আলোচনা করেন।
ইমাম ইবনে খালদুন। তিনি মুসলিম জাহানের একজন খ্যাতিমান সমাজবিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবিদ। তিনি তার বিভিন্ন লেখায় শ্রমবণ্টন, মূল্য, চাহিদা, জোগান, ভোগ, সরকারের অর্থসংস্থান ও বাণিজ্যচক্র নিয়ে আলোচনা করেন। ইবনে খালদুনের মতে অতিরিক্ত অপব্যয়ের কারণে একটি বিরাট সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। তিনি দেশের অর্থনীতিতে সরকারের হস্তক্ষেপকে নিরুৎসাহিত করেন এবং বাজারকে সুষম বণ্টনের উপায় হিসেবে উল্লেখ করেন। অ্যাডাম স্মিথের বহু আগে তিনি শ্রমবণ্টনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করেন। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান এর উপদেষ্টা এবং অর্থনীতিবিদ Arthur Laffer তার Laffer Curve-এর জন্য বিখ্যাত। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো ইবনে খালদুন কয়েকশত বছর আগে এই Curve-এর ধারণা দিয়েছিলেন। এমনকি Arther Laffer-ও কোনো সময় বলেননি যে তিনি Laffer Curve-এর উদ্ভাবক; বরং Laffer নিজেই এর কৃতিত্ব ইবনে খালদুনকে দিয়েছেন।
ইবনে খালদুন শ্রমবণ্টনের সুবিধা নিয়ে আলোচনা করেছেন। পাশ্চাত্যের অর্থনীতিবিদ Spengler শ্রমবণ্টনের ব্যাপারে ইবনে খালদুনের চিন্তা-ভাবনা সংক্ষেপে উপস্থাপন করেন ১৯৬৪ সালে।
ইমাম গাজ্জালি (রহ.)। তার লেখা থেকে কল্যাণমূলক অর্থনীতির ধারণা পাওয়া যায়। তার “এহইয়াও উলুমুদ্দিন” বইয়ে তিনি দেশের আর্থিক নিরাপত্তা রক্ষায় অনুসরণীয় নীতিমালা নিয়ে আলোচনা করেছেন। ইমাম গাজ্জালি (রহ.)-এর মতে দেশের মানুষের জীবন, বুদ্ধিমত্তা, বংশধারা, সম্পত্তি ও সম্পদের নিরাপত্তা দেবে সরকার।
গ্রিক ও রোমান সমাজেও বাজার দেখাশোনার জন্য বিশেষ কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হতো। এ সংক্রান্ত অফিসগুলোকে বলা হতো Agoronomos. অনেক ইউরোপীয় পন্ডিতের দাবি, এই Agoronomos থেকেই মুসলিমরা ‘আল-হিসবার’ ধারণা নিয়েছিলো।
আল-মাওয়ারদি। তিনি কোরআনেই ‘আল-হিসবা’র ধারণার অস্তিত্বের বিষয়টা তুলে ধরেন। ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, “রাসুল (সা.) ও খোলাফায়ে রাশেদিনের আমলেও বাজার পর্যবেক্ষণ ও তদন্তের প্রমাণ পাওয়া যায়।”
বর্তমান পৃথিবীর পুঁজিবাদী অর্থনীতির ভোগবাদী দর্শন অনেক রাষ্ট্র ও সাধারণ মানুষকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিচ্ছে। দুনিয়ার মানুষ পুঁজিবাদী অর্থনীতি থেকে বাঁচতে আশ্রয় খুঁজেছিলো সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি মানুষের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়। প্রকৃতপক্ষে মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করতে হলে ইসলামি অর্থনীতির কাছেই ফিরে যেতে হবে।


সাহিত্যঃ খলিফা মনসুর, খলিফা হারুন উর রশিদ, জালাল উদ্দিন রুমি, শেখ সাদী এবং পারস্যের সুলতানগণ। উপমহাদেশের আমির খসরু, যার হাতে কাব্য সাহিত্য সুর ও সঙ্গীত এর উৎকর্ষ সাধিত হয়। কবি নজরুল ইসলাম, কবি গোলাম মোস্তফা, জসিম উদ্দিন, ফররুখ আহমদ।

ইতিহাসঃ ইবনে খালদুন। কিতাব আল-ইবার ছিলো তার বিখ্যাত বই। বইটির প্রথম অংশ মুকাদ্দিমা (ভূমিকা), দ্বিতীয় অংশে আরব ও প্রতিবেশী জাতিসমূহের ইতিহাস, তৃতীয় অংশে উত্তর আফ্রিকার বার্বার এবং অন্যান্য মুসলিম রাজবংশের ইতিহাস আলোচিত হয়েছে। ইবনে খালদুনের জগৎজোড়া খ্যাতি মুকাদ্দিমার উপর নির্ভরশীল। এতে তিনি এমন একটি ইতিহাসের তথ্য পরিবেশন করেন, যাতে আবহাওয়া ও ভৌগোলিক পরিবেশ এবং অধিবাসীদের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শক্তিসমূহের উপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। পি.কে হিট্টি এর মতে, “কোনো আরব লেখক, বস্তুত কোনো ইউরোপীয় লেখক কখনোই যুগপৎ ইতিহাস সম্পর্কে খালদুনের মতো এত ব্যাপক ও দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেননি।”

এছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন আবিষ্কার, শিক্ষা-চিকিৎসাসহ বিভিন্ন খাতে নতুন দিগন্তের সূচনার ইতিহাস। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য–

ক্যামেরা আবিষ্কারঃ আলোকচিত্র গ্রহণ ও ধারণের যন্ত্র ক্যামেরা আবিষ্কারেও রয়েছে মুসলিমদের অবদান। ক্যামেরা বহুল ব্যবহৃত এবং জনপ্রিয়। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে একটি ক্যামেরার গুরুত্ব কতখানি তা সবাই কমবেশি বুঝি। এই অপরিহার্য যন্ত্র ক্যামেরার উদ্ভাবকও একজন মুসলিম বিজ্ঞানী। তার নাম ইবনুল হাইসাম। ১০২১ সালে এই মুসলিম বিজ্ঞানী প্রথম ক্যামেরা উদ্ভাবনের ধারণা দেন। “কিতাব আল মানাজির” গ্রন্থে এ ধারণা পাওয়া যায়। তবে পূর্ণাঙ্গ ক্যামেরা আবিষ্কার হতে আরও বহু বছর কেটে যায়। পরবর্তীতে কয়েক ধাপে ক্যামেরায় নতুনত্ব যুক্ত করেন বিজ্ঞানীরা। অবশেষে ১৯৭৫ সালে কোডাকের স্টিভেন স্যাসোন প্রথম ডিজিটাল ক্যামেরা মানুষের সামনে নিয়ে আসেন।
ইবনে আল হাইথাম রচিত “কিতাব আল মানাজির” অর্থাৎ “বুক অব অপটিকস”কে নিউটনের “প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা”র সমকক্ষ ধরা হয়। তিনি আলোকরশ্মির সরল পথে গমনের বিষয়টি পরীক্ষা করেন এবং প্রমাণ করেন। বিখ্যাত রজার বেকন ও জোহান কেপলারের মতো বিজ্ঞানীরা হাইথামের বুক অব অপটিকস দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন।

দিক নির্ণয়ের যন্ত্র ও মানচিত্র উদ্ভাবনঃ জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো মুসলিমরা দিকনির্ণয় যন্ত্র উদ্ভাবন এবং নদ-নদী ও সাগর-মহাসাগরের মানচিত্র তৈরিতেও অবদান রাখেন। মানচিত্র জগতে মুসলমানদের অবদানের কথা উল্লেখ করতে গেলে সর্বপ্রথম স্মরণ করতে হয় আল ইদ্রিসীর নাম। সপ্তম শতকে স্পেনে জন্মগ্রহণকারী এই মনীষী সমসাময়িক পৃথিবী সম্পর্কে ব্যাপক জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। তার রচিত “আল রজারি” ভূচিত্রাবলি এতই প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলো যে, সমগ্র ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকা তার মানচিত্রকে ওয়ালম্যাপ হিসেবে ব্যবহার করতো। মানচিত্র অঙ্কনের পাশাপাশি দিকনির্ণয় যন্ত্র উদ্ভাবনেও মুসলমানরা অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছিলেন। ‘ম্যাগনেটিক নিডল’ সর্বপ্রথম উদ্ভাবন করেন আরবরা। তারা সমুদ্রে নৌ-চলাচলের ক্ষেত্রে এর ব্যবহার করতেন। মুসলমানদের অনুমতি ছাড়া অন্য কোনো জাতির যুদ্ধজাহাজ তখন ভূমধ্যসাগরে প্রবেশ করতে পারতো না।

প্যারাশুট আবিষ্কারঃ বলা হয়ে থাকে প্যারাশুটের আবিষ্কারক লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি। তিনিই প্রথম প্যারাশুটের একটি জটিল নকশা প্রণয়ন করেন। তার নকশার প্যারাশুটটি বহনকারীর ভর নিখুঁতভাবে বহন করতে সক্ষম ছিলো। কিন্তু যদি প্রশ্ন করা হয়, পৃথিবীতে প্রথম কোন ব্যক্তি শূন্যে উড়েছিলেন এবং কে সবার আগে প্যারাশুট আবিষ্কারের ধারণা দেন, তাহলে অবশ্যই মুসলিম বিজ্ঞানীর নাম সবার আগে চলে আসবে। তার নাম আব্বাস ইবনু ফিরনাস। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চিরও প্রায় ৮০০ বছর আগে ৮৭৫ সালে মুসলিম এই বিজ্ঞানী আকাশে ওড়েন। বিমান আবিষ্কারের প্রথম চিন্তক হিসেবে তাকেই ভাবা হয়। ফিরনাস ১০ মিনিট উড়েছিলেন। পাখির পালক জড়ো করে তা দিয়ে পাখা বানিয়ে স্পেনের কর্ডোভার উঁচু পাহাড় ‘জাবাল আল-আরুস’ থেকে উড়াল দিয়েছিলেন তিনি। উড্ডয়নকালে তার বয়স ছিলো ৭০ বছর। নামার সময় দেখলেন তিনি গতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলেন না, তখন তার মনে হলো পাখির লেজের কথা। কিন্তু তিনি লেজ বানাননি। সজোরে আছড়ে পড়লেন মাটিতে। আহত হলেন। এর পরও ১২ বছর বেঁচে ছিলেন, কিন্তু ফের কখনো মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়াল দেওয়ার সামর্থ্য তার ছিলো না।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাঃ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেওয়া হয় যোগ্য শিক্ষার্থীর সনদ, কিন্তু কতজন জানেন বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাতা একজন মুসলিম নারী! ফাতিমা আল-ফিহরি বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্ণধার। ৮৫৯ সালে উচ্চ শিক্ষার অগ্রপথিক হিসেবে তিনি মরক্কোর ফেজ নগরীতে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ঐতিহাসিকদের মতে এটি বিশ্বের প্রাচীনতম সনদ বিতরণকারী উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা বিশ্ববিদ্যালয়।


হাসপাতাল প্রতিষ্ঠাঃ পৃথিবীর ইতিহাসে নবম শতকে মিশরে সর্বপ্রথম হাসপাতাল ব্যবস্থার সূচনা হয়। আহমদ ইবনে তুলুন ৮৭২ সালে মিসরের রাজধানী কায়রোতে ‘আহমদ ইবনে তুলুন হাসপাতাল’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। নবম শতকে তিউনিসিয়ায় একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়। মধ্যযুগের এ সময়ে মুসলমানদের তৈরি সবচেয়ে ভালো বিস্তৃত বিন্যাস ও পরিবেশবান্ধব হাসপাতাল নির্মান করেন শাসক ওয়াদুদ আল ওয়ালিদ। তিনি এটি ৯৮২ সালে নির্মাণ করেন, যা বাগদাদে অবস্থিত। পরবর্তীতে হাসপাতালব্যবস্থার ধারণা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। অর্থাৎ আধুনিক বিশ্বে চিকিৎসার জন্য এই যে হাসপাতালব্যবস্থা, তা সর্বপ্রথম নিয়ে আসেন মুসলিমরা। ধীরে ধীরে গোটা বিশ্বে হাসপাতালব্যবস্থা চালু হয়।

বর্তমানে আমরা এমন এক যুগে বসবাস করছি, যেখানে একটি মুসলিম শিশু মুসলমানদের দুর্দিন ছাড়া আর কিছু দেখছে না। শুধু শিশু নয়, আবালবৃদ্ধবনিতা সবার মনে এমন একটি ধারনা কাজ করছে যে, বিজ্ঞান মানেই ইউরোপ আর আমেরিকা। তাদের কাছ থেকে আমাদের জ্ঞান বিজ্ঞান শিখতে হবে। কিন্তু আমাদের অনেকেই জানে না যে, মুসলমানরাই আধুনিক বিজ্ঞানের জন্মদাতা। আজকের এ অধঃপতিত মুসলমানদের পূর্বপুরুষরা কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত বিশ্বে জ্ঞানের আলো জ্বালিয়ে গেছেন। আজকের আলোকিত বিশ্ব তাদের কাছে ঋনী। বর্তমান বিশ্ব সভ্যতা মুসলমানদের কাছে ঋনী। মুসলমানরাই বিশ্ব সভ্যতাকে রক্ষা করেছেন। এ ব্যাপারে মুসলিম ঐতিহাসিক মোহাইমিনি মোহাম্মাদের একটি উক্তি উল্লেখযোগ্য। তিনি তার “গ্রেট মুসলিম ম্যাথমেটিশিয়ান” গ্রন্থের তৃতীয় পৃষ্ঠায় লিখেছেন, “In the seventh century, Western Europe was declining while the Byzantine and Persian empires were manifestly bent upon mutual destruction. Likewise, India was greatly divided. However, China was steadily expanding, the Turkish in central Asia were disposed to work in an accord with China. During this period, the world was saved by the rise of the Islamic civilization.”
অর্থাৎ “সপ্তম শতাব্দীতে পশ্চিম ইউরোপের পতন ঘটেছিলো। অন্যদিকে বাইজাইন্টাইন ও পারস্য সাম্রাজ্য একে অন্যের ধ্বংস সাধনে ছিলো সুস্পষ্টরূপে বদ্ধপরিকর। একইভাবে ভারত ছিলো মারাত্মকভাবে দ্বিধাবিভক্ত। তবে দৃঢ়তার সঙ্গে চীনের সম্প্রসারন ঘটছিলো। মধ্য এশিয়ায় তুর্কিরা চীনের সঙ্গে একটি সমঝোতার ভিত্তিতে কাজ করতে আগ্রহী ছিলো। এ সময় ইসলামী সভ্যতার উত্থানে বিশ্ব রক্ষা পায়।”
আবুল আসাদ বলেছেন, “মুসলমানদের অবদান মাইনাস করলে ইউরোপীয় রেনেসাঁ থাকে না।”
ঐতিহাসিক O.J.Thatcher এবং Ges F.Schwill তাদের ইতিহাস গ্রন্থে বলেছেন, “পয়গম্বর মোহাম্মদের মৃত্যুর পর পাঁচশো বছর তাঁর অনুগামীরা এমন এক সভ্যতার পত্তন ঘটায় যা ইউরোপের সবকিছু থেকে বহুগুণ অগ্রগামী।”

মুসলমানদের কাছে এই ইতিহাসগুলো অজানা, তাই এত গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে আবদ্ধ কারাগারে। তারা যখন কোনো বক্তৃতা বা বিবৃতিতে উদাহরণ দিতে যান, তখন তাদের মুখে পশ্চিমা সংস্কৃতির, ইউরোপিয়ান বা খ্রিস্টান মনীষিদের নাম আসে। আর তাতে তারা গর্ববোধও করেন। অথচ কোনো মুসলমান মনীষির নাম তাদের স্মরণে আসে না; নেপোলিয়ন, শেক্সপিয়ার, নিউটনের কথা মাথায় আসে কিন্তু খালিদ ইবনে ওয়ালিদ, সালাহউদ্দিন আইয়ুবী, হাসসান ইবনে সাবিত, ইবনে সিনা, ইবনে খালদুন, ইবনে রুশদ, আল-ফারাবি, আল কিন্দি সম্পর্কে তারা অজ্ঞ।

শিক্ষাঙ্গনে আমাদের সিলেবাস মুসলমানদের ইতিহাস শূণ্য। ইসলামের প্রতিদ্বন্দ্বীরা ইসলামকে বিকৃত করে, মুসলমানদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে ধামাচাপা দিয়ে আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছে তাদের ইতিহাস, যে ইতিহাস পড়তে পড়তে আমাদের শিক্ষা জীবন শেষ হয়ে যায় কিন্তু মুসলমানদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সম্পর্কে জানার সময় ও সুযোগ হয় না। তারা ইতিহাসকে বিকৃত করে ভিন্ন এক ইতিহাস মুসলমানদের সন্তানদেরকে গলধঃকরণ করতে বাধ্য করছে।
ইউরোপীয় ঐতিহাসিকদেরকে ইতিহাস শাস্ত্রের অনেক খুঁটিনাটি তত্ত্ব নিয়ে নাড়াচাড়া করতে দেখা যায়। মুসলমানরা তা দেখে অনেকটা হকচকিয়ে যান এবং পূর্ন আন্তরিকতার সাথে তাদের স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন। অথচ মুসলমানদের আজকের এই অবস্থা ছিলো না। তারা সমগ্র দুনিয়াকে আল্লাহর আমানত হিসেবে নিয়ে তাঁর প্রভূত্ব কায়েম করেছিলো মানুষের কাছে, অন্য মানুষের গোলামী নয়। আমরা জানি, আবারো মুসলমানরা জেগে উঠবে, এজন্য সবার আগে আগে আমাদের আত্মপরিচয় জানতে হবে, নিজেদের জাতীয় পরিচয় জানতে হবে। নিজেদের পরিচয় রক্ষার্থে আবারো জাগাতেই হবে মুসলিম মানসকে।

– আতিয়া সুলতানা তাইয়্যিবা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *