শিউলিমালা একাডেমি

“কুতুব মিনার”

ভারতে মুসলিম বিজয়ের অন্যতম স্মারক দিল্লিতে অবস্থিত কুতুব মিনার। লাল বেলেপাথরের ইট আর উপরের দিকে মার্বেল দিয়ে তৈরি এ মিনার বিশ্বের সর্বোচ্চ ইট-নির্মিত মিনার। কুতুব মিনার কুতুব কমপ্লেক্সের মধ্যে অবস্থিত। মিনার এবং তার আশেপাশে বেশ কিছু প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় স্থাপনা এবং ধ্বংসাবশেষ একত্রে কুতুব কমপ্লেক্স হিসেবে পরিচিত। মিনার ছাড়াও এখানে আছে কুওওত-উল-ইসলাম মসজিদ, আলাউদ্দিন খলজির মাদরাসা, আলাই দরজা, অসমাপ্ত আলাই মিনার, লৌহ স্তম্ভ; আলাউদ্দিন খলজি, গিয়াস উদ্দিন বলবন ও ইলতুৎমিশের সমাধি।

প্রায় ৮শ বছরের পুরনো এ স্থাপনার কাছে গেলে এখনো মনে হয় নির্মাণ কাজ সদ্য শেষ হলো! মিনারটি শরীর এত ঝকঝকে যে, তা দেখে বোঝার উপায় নেই এটি এত আগে নির্মিত। এ স্থাপনার গায়ে খচিত কোরআনের আয়াত ও টেরাকোটার কাজ মনোমুগ্ধকর। এর যত কাছে যাওয়া যায়, তত আকর্ষণ বাড়তে থাকে। শুধু কুতুব মিনার নয়, পুরো কমপ্লেক্সটিই দর্শনার্থীদের জন্য বিস্ময়।

কুতুব মিনারের নামকরণের পেছনে দুটি অভিমত রয়েছে। প্রথমটি হলো এর নির্মাতা কুতুব উদ্দিন আইবেকের নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়েছে, দ্বিতীয়টি হলো ট্রান্সঅক্সিয়ানা হতে আগত বিখ্যাত সুফী সাধক হযরত কুতুব উদ্দিন বখতিয়ার কাকীর সম্মানার্থে এর নামকরণ করা হয়েছে।

১১৯২ সালে ত্বরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে রাজা পৃথ্বীরাজের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসেন কুতুব উদ্দিন আইবেক। তারপর তিনি যুদ্ধে বিজয়ের সূচক হিসেবে ১১৯৯ সালে কুতুব মিনারের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। ১২১০ সালে তার মত্যুর পর তার জামাতা শামসুদ্দিন ইলতুৎমিশ ১২২০ সালে এটির অবশিষ্ট কাজ সমাপ্ত করেন। তার মৃত্যুর পর আলাউদ্দিন খলজি এটিকে সম্প্রসারণ করার কাজে হাত দেন, কিন্তু শেষ করে যেতে পারেননি। তার নির্মিত অসম্পূর্ণ মিনারকে আলাই মিনার বলা হয়। কুতুব মিনার দু’বার বজ্রপাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়; ১৩২৬ ও ১৩৬৮ খ্রিস্টাব্দে। প্রথমবার মুহাম্মদ তুঘলক এবং দ্বিতীয়বার ফিরোজশাহ্ তুঘলক ক্ষতিগ্রস্ত মিনারের মেরামত করেন। আরো পরে ১৫০৩ খ্রিস্টাব্দে সিকান্দার লোদী মিনারের সর্বোচ্চ তলটি পুনরায় মেরামত করেন।

আফগানিস্তানের জাম মিনার এর অনুকরণে কুতুব মিনার নির্মিত হয়। ভারত ও ইরান থেকে আসা কর্মচারীগণ এটির নির্মাণ কাজে জড়িত ছিলেন, যার ফলে ইরানের স্থাপত্য নিদর্শন লক্ষ্য করা যায়। ফটকগুলোতে আরবি ভাষায় বিভিন্ন নকশা খচিত রয়েছে। পাঁচ তলা বিশিষ্ট মিনারের প্রতিটি তলায় রয়েছে ব্যালকনি বা ঝুলন্ত বারান্দা। মিনারটি বিভিন্ন নলাকার শ্যাফট দিয়ে গঠিত যা এসব বারান্দা দ্বারা পৃথকীকৃত। প্রাথমিক অবস্থায় এটি চার তলা মিনার ছিলো; ফিরোজশাহ্ মেরামতের সময় সর্বোচ্চ তলটি দু’ভাগে বিভক্ত করেন, ফলে বর্তমানে এটি পাঁচ তলা। প্রাথমিক অবস্থায় সবটাই ছিলো লাল পাথরের গাঁথুনি, ফিরোজশাহ্ মেরামতের সময় উপরের দুটি তলা সাদা মার্বেল দিয়ে তৈরি করেন।

নিচের তলায় ছাব্বিশটি পল তোলা, যেগুলো পর্যায়ক্রমে একটি গোলাকৃতির, অন্যটি কোণ বিশিষ্ট। মুজতবা আলীর ভাষায়, “একটা বাঁশি, একটা কোনা পর পর সাজানো।” পরপর দুটি বাঁশি কেন্দ্রবিন্দুতে ৩০ ডিগ্রি কোণ রচনা করেছে, আর তাতেই কোণগুলো সাজানো। দোতলায়ও রয়েছে ছাব্বিশটি খাঁজ, প্রতিটি খাঁজ কেন্দ্রে ১৫ ডিগ্রি কোণ রচনা করছে এবং এগুলোও গোলাকৃতির। তিনতলাতেও রয়েছে ছাব্বিশ ভাগের ছন্দ, তবে এগুলোর সবই কোণাকৃতির।

দৃঢ়তা বা ভারসাম্যের প্রয়োজনে মিনার ক্রমশঃ মোটা থেকে সরু হয়ে উঠেছে। তবে এক্ষেত্রে স্থপতি ভারসাম্যের প্রয়োজনের চেয়ে গঠনের সৌন্দর্যকেই বেশি প্রকট করেছেন, যার উদ্দেশ্য ছিলো দর্শককে বিভ্রান্ত করা! ফলশ্রুতিতে মিনার বাস্তবে যত উঁচু, দেখতে তারচেয়েও বেশি উঁচু মনে হয়।

কতুব মিনারের উচ্চতা ৭১.২৪ মিটার বা ২৩৪ ফুট যা প্রায় বর্তমান সময়ের ১৭ তলা ভবনের সমান। পাদদেশে বৃত্তের ব্যাস ১৪.৩২ মিটার এবং উপরের অংশে ২.৭৫ মিটার। সিঁড়ির সংখ্যা ৩৭৯ টি।

চত্বরের সামনে একটা লৌহ স্তম্ভ রয়েছে। স্তম্ভের সামনের এপিটাফের তথ্য অনুযায়ী ২৪ ফুট উচ্চতার এ স্তম্ভের বয়স প্রায় ১৬শ বছর, অর্থাৎ মিনার তৈরিরও ৮শ বছর আগের। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের আমলে এটি নির্মিত হয়। নির্মাণ কৌশল আর ভালো মানের লোহা ব্যবহার করায় এত বছর পরেও এতে জং পড়েনি একটুও। এর ওজন ৬ হাজার কেজি।

কুতুব মিনারের দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে ২৫ ইঞ্চি একটি ঢাল আছে যা ‘নিরাপদ সীমা’ হিসেবে বিবেচিত হয়।

এতে প্রবেশের যে দরজাটি ১৯৮৪ সালে রাষ্ট্রীয়ভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর পেছনে কিছু কারণ রয়েছে। একবার ৪০০ দর্শনার্থী এতে প্রবেশ করে, হঠাৎ এর ভেতরের বিদ্যুত চলে যায়, যার ফলে অসংখ্য দর্শনার্থী সিঁড়ি থেকে পড়ে মারা যায়, যার অধিকাংশই ছিলো স্কুলের ছাত্রছাত্রী। পরে আরো কয়েকবার বিদ্যুৎজনিত সমস্যা সৃষ্টি হলে এর দরজায় রাষ্ট্রীভাবে তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়।

দিল্লির অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন-গন্তব্য এ কমপ্লেক্সটিকে ইউনেস্কো ১৯৯৩ সালে বিশ্ব ঐতিহ্যের স্থান হিসেবে তালিকাবদ্ধ করে।


সংকলক: বুশরাতুল জান্নাহ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *