শিউলিমালা একাডেমি

কারাউইন বিশ্ববিদ্যালয় ও একজন স্বপ্নদ্রষ্টা ফাতিমা আল ফিহরি

পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় কারাউইন বিশ্ববিদ্যালয় (পূর্বের কারাউইন মসজিদ)। ইতিহাসের অপব্যাখ্যায় মলিন, ইউরোপীয় রেনেসাঁর প্রকৃত উৎস; বাগদাদ, আন্দালুস, কায়রোর ‘মধ্যযুগ’ এর মুসলিম সভ্যতার অনন্য সংযোজন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের গোড়াপত্তনের ইতিহাসের সাথে মিশে আছে এক নারীর নাম। ফাতিমা আল ফিহরি! বর্তমান তিউনিসিয়ার কায়রোয়ান শহরে জন্মগ্রহণকারী এই মুসলিম নারী কর্তৃক ৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে মরক্কোর ফেজ এ প্রতিষ্ঠিত কারাউইন বিশ্ববিদ্যালয়ই বিশ্বের প্রথম ও প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়, যা এখন পর্যন্ত টানা চালু আছে (তথ্যসূত্র: ইউনেসকো ও গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ড)।

পড়াশোনার প্রতি প্রবল আগ্রহী, বিচক্ষণ ও প্রচন্ড পরিশ্রমী এ নারী প্রথম জীবনে একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। সেই সাথে তিনি ছিলেন একজন সফল মা, যিনি তার সন্তানদের পরিপূর্ণ শিক্ষা লাভের ব্যবস্থা করেন। প্রথম জীবনে ফাতিমা আল ফিহরির পিতার আর্থিক অনটন, এ কারণে কায়রোয়ান ছেড়ে মরক্কোর ফেজ এ স্বপরিবারে পাড়ি জমানো এবং পিতার কঠোর পরিশ্রমের ফলে ক্রমান্বয়ে আর্থিক স্বচ্ছলতা অর্জনের ঘটনাই মূলত তাকে প্রেরণা জোগায়। তিনি ছিলেন খুবই আত্মবিশ্বাসী একজন নারী। খুব কম বয়সেই তিনি তার পিতা, স্বামী ও ভাইকে হারান। তারপর তিনি ও তার বোন ব্যবসায়ী পিতার রেখে যাওয়া সম্পদ মানবতার কল্যাণে ব্যয় করার উদ্দেশ্যে পৃথক দুটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। ফাতিমার প্রতিষ্ঠিত মসজিদটি ছিলো তৎকালীন উত্তর আফ্রিকার বৃহৎ মসজিদ, দ্বাদশ শতাব্দীতে পুনরায় পরিবর্ধনের পরে যেখানে একসাথে ২২ হাজার মানুষ নামাজ পড়তে পারতো। মসজিদের বর্ধিতাংশে তিনি একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে ইসলামী শিক্ষার পাশাপাশি রাজনৈতিক শিক্ষা, সাধারণ বিজ্ঞান, গণিত, ব্যাকরণ, চিকিৎসাশাস্ত্র, ইতিহাস, জ্যোতির্বিদ্যা, ভূগোল, রসায়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে পাঠদান করানো হতো। অতঃপর এখান থেকে ডিগ্রি প্রদানের প্রচলন শুরু হয়, আর রচিত হয় বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এটি মধ্যযুগে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে উচ্চশিক্ষার একটি প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়। অনেক প্রসিদ্ধ উলামায়ে কেরাম সেখানে অধ্যয়ন করেছেন, তন্মধ্যে রয়েছেন প্রখ্যাত মালেকী ফকিহ আবু ইমরান আল-ফাসী, প্রখ্যাত ঐতিহাসিক আবদুর রহমান ইবনে খালদুন, প্রসিদ্ধ গণিতবিদ আবুল আব্বাস আহমাদ ইবনু মুহাম্মাদ ইবনে উসমান, আবু বকর ইবনে ইয়াহইয়া ইবনে যায়ে প্রমুখ। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম স্বতন্ত্র দিক হলো এখানে সব ধর্মের মানুষদের পড়ালেখা করার সুযোগ রাখা হয়েছিলো। খ্রিষ্টানদের পোপ দ্বিতীয় সিলভেস্টার এবং ইহুদি চিকিৎসাবিদ ও দার্শনিক মায়মোনাইডস এই বিশ্ববিদ্যালয় বিখ্যাত ছাত্র ছিলেন। পোপ দ্বিতীয় সিলভেস্টার এখান থেকে আরবী সংখ্যাপদ্ধতি বিষয়ে ধারণা লাভ করেছিলেন এবং সেই জ্ঞান ইউরোপে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, ইউরোপীয়দেরকে প্রথম শূন্যের (০) ধারণার সাথে পরিচিত করেছিলেন।

ফাতিমা আল ফিহরি মসজিদ প্রাঙ্গণে একটি লাইব্রেরিও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কারাউইন বিশ্ববিদ্যায়ের এ লাইব্রেরিটিকে বিশ্বের প্রাচীনতম লাইব্রেরি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আগুনে পুড়ে লাইব্রেরির বিপুল সংখ্যক পাণ্ডুলিপি নষ্ট হয়ে যাওয়ার পরেও এখনো এখানে প্রায় ৪,০০০ প্রাচীন এবং দুর্লভ পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত আছে, যার মধ্যে রয়েছে নবম শতকে চামড়ার উপর কুফি লিপিতে লিখিত একটি কোরআন শরীফ, হাদিসের সংকলন, ইমাম মালিকের “মুয়াত্তা”, ইবনে ইসহাকের “রাসূল (সা.)-এর জীবনী”, ইবনে খালদুনের “আল ইবার” এবং “আল-মুকাদ্দিমা”র মূল পাণ্ডুলিপি।

তার প্রতিষ্ঠিত কারাউইন মসজিদ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং লাইব্রেরিটি যুগে যুগে সংস্কার, পরিবর্ধনের নানা ধাপ পেরিয়ে আধুনিক রূপ নিয়ে আজও সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গত সহস্রাধিক বছরে লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী জ্ঞানার্জন করেছে, সমৃদ্ধ হয়েছে বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডার।

কর্মদীপ্ত জীবনের অধিকারী মহীয়সী ফাতিমা আল ফিহরি সম্পর্কে ইবনে খালদুন বলেছিলেন, “তিনি যেন পরবর্তী বড় বড় শাসকদেরকে আঙ্গুল উঁচিয়ে দেখিয়ে গেলেন, এটি হলো আল্লাহ তা’আলার অনুগ্রহ। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে যাকে ইচ্ছা তাকে এই মর্যাদা দান করেন। আল্লাহ যখন কোনো জাতির উন্নতি এবং সমৃদ্ধি চান, তাদের জন্য সৌভাগ্যের দুয়ার খুলে দিতে চান, তখন তাদের মধ্য থেকে কিছু মহৎ ব্যক্তি এবং মহীয়সী নারীগণকে প্রস্তুত করেন, যারা সমাজে জাগিয়ে তোলেন কল্যাণের নব স্রোতধারা।”

কারাউইন বিশ্ববিদ্যালয় ও ফাতিমা আল ফিহরি আমাদের স্বর্ণালী অতীতের সাক্ষী, ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির অন্তঃমূলের সাক্ষী। ফাতিমা আল ফিহরি বার বার মনে করিয়ে দেন, আমরা হতে পারি সমাজে কল্যাণের নব স্রোতধারা জাগিয়ে তোলা মহীয়সী…


সংকলক: কাজী সালমা বিনতে সলিম

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *