রাসূল (সাঃ) মদীনায় হিজরতের পর যে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনা দেন এবং তা বাস্তবায়ন করেন সেগুলো হলো–
১. মসজিদ প্রতিষ্ঠা
২. ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা
৩. বাজার প্রতিষ্ঠা
এক্ষেত্রে তিনি ইহুদীদের বাজার ব্যবস্থার বিপরীতে নতুন ও বিকল্প বাজার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন, যার মূলমন্ত্র ছিলো ‘সুদ ও শোষনের অর্থনীতির সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই’। তারই ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন খোলাফায়ে রাশেদা ও পরবর্তী মুসলিম শাসকগণ। সকল ধরণের অভাব, দারিদ্র্যতা ও অর্থনৈতিক সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে ওমর (রাঃ) আলাদাভাবে গুরুত্ব দেন কৃষির উপর। তিনি প্রায় তিনশোর কাছাকাছি নতুন উদ্যোগ ও সংস্কার করেন। তন্মধ্যে অন্যতম হলো–
- সকল অনাবাদী জমিতে চাষাবাদ করানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রীয়ভাবে কৃষকদের পুঁজি প্রদান করেন এবং বহুজনকে জমির মালিকানা প্রদান করেন। এক্ষেত্রে নির্দেশনা দেওয়া হয়– উৎপাদিত ফসলের ৫০% রাষ্ট্র পাবে বাকি ৫০% কৃষকের থাকবে (পুঁজি ও জমি কিন্তু রাষ্ট্রই প্রদান করেছে), সেখান থেকে অবস্থা অনুযায়ী যাকাতও দিতে হবে।
- গণিমতের মাল আসার পর যোদ্ধাদের মধ্যে বিতরণ না করে সেই সময়ের সবচেয়ে বড় চাহিদা, কৃষির উন্নয়নে ব্যয় করেন।
- সুয়েজ খাল, যার মাধ্যমে পৃথিবীর ৭০% অর্থনীতি নিয়ন্ত্রিত হয়ে, সেই খালের রূপরেখা অঙ্কন করেন।
- সেচ প্রকল্প ও ড্রেনেজ সিস্টেম প্রবর্তন করেন।
- সমুদ্র ব্যবস্থার রূপরেখা অঙ্কন করেন।
একইভাবে আমরা দেখতে পাই, হযরত আলী (রাঃ) মিশরের গভর্নর মুসা আল আশয়ারীর কাছে চিঠি পাঠান। তিনি বলেন, “হে মুসা আল আশয়ারী, সুষম উৎপাদন বৃদ্ধি করো, সুষম বন্টন নিশ্চিত করো।”
যেখানে একটা সময় রাষ্ট্রপ্রধান পেটে পাথর বেঁধে রাখতেন, একটি খেজুর খেয়ে দিনাতিপাত করতেন। বাচ্চাদের মিথ্যে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য হাড়িতে শুধু পানি ফোটানো হতো। ইতিহাস সাক্ষী দেয়, আল্লাহর রাসূলের (সাঃ) ইসলামী অর্থনীতি কায়েমের পরবর্তী ৮ বছরের জীবনকাল, আবু বকরের (রাঃ) ২ বছর ও ওমরের (রাঃ) ১০ বছরের শাসনামল– মোট ২০ বছরের ব্যবধানে পুরো জাযিরাতুল আরবের ৩৮ লক্ষ বর্গমাইলে যাকাত নেওয়ার জন্য একজন লোকও খুঁজে পাওয়া কষ্টকর হয়ে যায়।
রাসূল (সাঃ), খোলাফায়ে রাশেদাগণ ও পরবর্তী শাসকদের শাসনামলে উষর মরুবেষ্টিত অঞ্চলেই কৃষি অর্থনীতির ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়েছিলো। যে অঞ্চল কৃষিপ্রধান নয় সে অঞ্চলই যদি কৃষিতে এত উন্নতি সাধন করে, তাহলে কৃষিপ্রধান অঞ্চলসূমহে কত ব্যাপক অগ্রগতি অর্জিত হয়েছিলো তা নিয়ে বিস্তর পর্যালোচনার প্রয়োজন। ইসলাম যেসব অঞ্চলেই গিয়েছে, উন্নত কৃষি, উন্নত খাদ্যনীতির উপর গুরুত্ব দিয়েছে এবং সাফল্যও অর্জন করেছে। এক্ষেত্রে কৃষিপ্রধান অঞ্চলগুলোর মধ্যে প্রাচীন বাংলা উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
বৃটিশ পূর্ববর্তী সময় অর্থাৎ বাংলা সালতানাত ও মুঘল শাসনামলে আমাদের অঞ্চলের অন্যতম ভিত্তি ছিলো কৃষি। সে সময় কৃষি ব্যবস্থা এতটাই উন্নত ছিলো যে, ২৫০টিরও বেশি ফসল আমরা বিভিন্ন অঞ্চলে রপ্তানি করতাম।
বাংলা অঞ্চলে রয়েছে সম্ভাবনার অকুল আঁধার। যেমন:
- উর্বর মাটি, অনুকূল আবহাওয়া
- ছোট বড় অসংখ্য নদী
- অধিক ঋতু
- বৃহৎ বনাঞ্চল
- প্রাকৃতিক গ্যাস, তেল, কয়লা, চুনাপাথর, কঠিন শিলা, চিনামাটিসহ অসংখ্য খনিজ সম্পদ
বাংলার কৃষি অর্থনীতির ইতিহাস উন্নত কৃষি ব্যবস্থার স্বর্ণালি অধ্যায়। বাংলার প্রকৃতি-পরিবেশও কৃষির জন্য যথেষ্ট অনুকূল।
এ প্রেক্ষিতে বর্তমানে আমাদের অঞ্চলে কৃষি ও খাদ্য ব্যবস্থা কেমন? বর্তমান ভয়াবহ পরিস্থিতি কারোরই অজানা নয় অর্থাৎ নিদারুণ শোচনীয়। কিন্ত এর মূল কারণ কী?
বর্তমানে সমগ্র পৃথিবী পরিচালনা করছে মানবসভ্যতার জন্য হুমকি ‘জায়নবাদি গোষ্ঠী’, যারা নিজেদেরকে সমগ্র মানবজাতির উপর শ্রেষ্ঠ বিবেচনা করার অসুস্থ মানসিকতা লালন করে থাকে। ব্রিটেনের রথচাইল্ড, জাপানের মিটসুবিশি, আমেরিকার রকফেল্লাররাই আজ বিশ্ব অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক; ৭ টি বড় বড় হোল্ডিংয়ের ব্যাংক জায়নবাদীদের। বিশ্বের সর্ববৃহৎ তিনটি credit rating agencies ও তাদেরই। অর্থনীতিবিদগণ বলে থাকেন যে, ১৯৩০, ১৯৭০ এবং ২০০৮ সালে সংঘটিত সর্ববৃহৎ ৩ টি বড় অর্থনৈতিক সঙ্কটের পেছনে দায়ী ছিলো এ ইহুদীরা। শুধু অর্থনীতি নয়, বর্তমান দুনিয়ার প্রায় সকল সেক্টর আজ জায়নবাদীদের দখলে।
বীজ, কৃষিপণ্য এবং কীটনাশক উৎপাদনকারী নিয়ন্ত্রণকারী বৃহৎ কোম্পানিসমূহ হলো–
১। Cargill
২। Bayer
৩। DuPont
৪। Monsanto
৫। Syngenta
এ সকল কোম্পানিও তাদের পরিচালিত। বীজ উৎপাদনকারী কোম্পানিসূমহ বীজগুলোকে প্রচন্ডমাত্রায় বিষাক্ত করে তৈরি করে, অর্থাৎ বীজকে জেনেটিকালি মোডিফাই করা হয়। জেনেটিকালি মোডিফাইড বীজে এমন কিছু কৃত্রিম পরিবর্তন আনা হয় যা মানব দেহের জন্য ক্ষতিকারক। তারা বীজের আংশিক বিষাক্ত করে মূলত, যার ফলে সেখানে পোকা তৈরী হয়। আবার ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে বীজে ক্ষতিকারক পোকার আক্রমণ ও বিস্তার রোধে আমরা ব্যবহার করি তাদেরই তৈরি মারাত্মক বিষক্রিয়াযুক্ত কীটনাশক। এ
কীটনাশকগুলো পোকার প্রজনন ক্ষমতা বিনষ্ট করে; আর বিষক্রিয়ার ফলস্বরূপ বীজ থেকে প্রাপ্ত ফসল, ফল-ফলাদি, শাকসবজি গ্রহণ করে আমাদের দেশের তরুণ প্রজন্মও তাদের বংশবৃদ্ধির ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে।
এ প্রসঙ্গে সূরা বাক্বারার ২০৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তা’আলা বহু আগেই আমাদের সতর্ক করেছেন। পবিত্র কোরআনের সূরা আল বাকারার ২০৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
وَإِذَا تَوَلَّىٰ سَعَىٰ فِي الْأَرْضِ لِيُفْسِدَ فِيهَا وَيُهْلِكَ الْحَرْثَ وَالنَّسْلَ ۗ وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ الْفَسَادَ
“যখন সে কর্তৃত্ব লাভ করে, পৃথিবীতে তার সমস্ত প্রচেষ্টা-সাধনা নিয়োজিত করে বিপর্যয় সৃষ্টি এবং শস্যক্ষেত ও মানব বংশ ধ্বংস করার কাজে ৷ অথচ আল্লাহ (যাকে সে সাক্ষী মেনেছিলো) বিপর্যয় মোটেই পছন্দ করেন না ৷”
এ কোম্পানিগুলো বীজের পাশাপাশি খাদ্য ব্যবস্থাকেও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে এইডস, ডায়াবেটিকস, বার্ড-ফ্লু সহ আরো অনেক রোগের জীবাণু ছড়ানোর পেছনে এরাই দায়ী। যেমন: গম ও চালের জিনের সাথে তারা ডায়াবেটিকস সহ আরও নানাবিধ রোগের জীবানু মিশিয়ে থাকে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আশা করি আরও বেশি স্পষ্ট হবে। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ চকলেট এবং চিনিজাত পণ্য বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান হলো নেসলে (Nestle); আবার ডায়াবেটিকস কিংবা চিনি খাওয়ার ফলে যে সকল অসুখ শরীরে দানা বাঁধে, তার মেন্টাংস (metanx) নামক ঔষধও তৈরি করে এ একই কোম্পানি!
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ১৯৭০ সালে বলেছিলেন, “Control oil and you control nations; control food and you control the people.” অর্থাৎ, “যদি তুমি তেলকে নিয়ন্ত্রন কর, তাহলে তুমি একটি জাতিকে নিয়ন্ত্রন করতে পারবে। আর যদি তুমি খাদ্যকে নিয়ন্ত্রন কর, তাহলে মানুষকে অর্থাৎ সারা পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।”
আমাদের কৃষি, খাদ্য নিয়ন্ত্রণ করে মানুষের শারীরকে অসুস্থ, দুর্বল, নষ্ট চিন্তার অধিকারী, অলস, বিলাসী, শক্তি ও চেতনাহীন বানানোই বর্তমানে তাদের বিকৃত উদ্দেশ্য সাধনের এজেন্ডায় পরিণত হয়েছে। এক্ষেত্রে তারা যথেষ্ট সফলতার মুখও দেখেছে, উপমহাদেশের ভঙ্গুর কৃষি ব্যবস্থা যার প্রমাণ।
দুর্বল কৃষি অর্থনীতির অবস্থা বর্তমান করোনাকালীন সময়ে আরো ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। লাখ লাখ মানুষ চাকরিচ্যুত হয়ে কর্মসংস্থান হারিয়ে, রেমিটেন্স যোদ্ধারা প্রবাস থেকে ফিরে গ্রামমুখী হয়েছে। বিপুল পরিমাণ মানুষ এখন গ্রামে ফিরে যাচ্ছে। গ্রামে ফিরে আসা মানুষদের কর্মক্ষেত্রের জন্য অবশিষ্ট যে খাত বাকি থাকে, তা হলো কৃষি।
কিন্তু প্রশ্ন হলো গ্রামীণ যে কর্মক্ষেত্র, যে কৃষি ব্যবস্থা, তা কি আদৌ এ কর্মসংস্থাহীন মানুষদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে সক্ষম?
যেখানে প্রায় ৭০% কৃষক ভূমিহীন; বর্গা চাষ করে ফসলের ৫০% মালিককে দিয়ে দিতে হয়। তারা তো সরকারের তালিকারই বাইরে, সরকার থেকে কোনো ঋণ পাচ্ছে না। এ বছর সরকার কৃষি খাতে ভর্তুকি দিয়েছে ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা; অথচ ধান ছাড়া সব ফসলই আমাদেরকে বাহির থেকে আমদানি করতে হচ্ছে! এ রকম ভয়াবহ পরিস্থিতিতে নতুন করে কৃষি কর্মসংস্থানের আশা করা নিতান্তই অমূলক।
LLRD এর মতে বর্তমানে ৫০% পুরুষ এবং ৬০% নারী কৃষক পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। অব্যবস্থাপনা, সিন্ডিকেটের দরুন কৃষকরা ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না।
মৎস খাতের কথাও কিইবা বলা আছে! আমেরিকান একটা সংস্থা বলছে, বাংলাদেশে চাষকৃত মাছের ৪৫ শতাংশ রপ্তানি হয় অথচ কোনো ইন্ডাস্ট্রি নেই। এ নিয়ে রাষ্ট্রীয় সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও বাজেট নেই। যদি থাকতো, তবে ১০ টাকার জায়গায় আয় হতো ৭০০০ টাকা।
এ সকল ক্ষেত্রগুলো ছাড়াও আরো অনেক সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র দিন দিন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হচ্ছে। সেগুলো নিয়ে না আছো কোনো গবেষণা, না আছে কোনো প্রস্তাবনা! নীরবেই হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে আমাদের অপার সম্ভাবনার এ ক্ষেত্রগুলো!
ফলশ্রুতিতে ২৫০ টি অঞ্চলে রপ্তানি করা বাংলা অঞ্চল এখন ধান ব্যতীত সব ফসল বিদেশী কোম্পানি থেকে আমদানি করে!
ভয়াবহ বেকারত্ব এবং দারিদ্র্য বেড়ে গিয়ে এখন ৪২ ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে! (সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো)
এভাবে চলতে থাকলে দেশের ভবিষ্যৎ কোন দিকে তা কি আমরা ভাবতে পারছি?
বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা, কৃষি ও অর্থনীতির রাজনীতিকে বুঝে ইসলামী মূলনীতির আলোকে কর্মসূূচি গ্রহন, সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা ও ব্যবস্থাপনা প্রণয়ন, কৃষকদের সঠিক নির্দেশনা এখন সময়ের সবচেয়ে বড় দাবী। তাই আমি মনে করি কৃষিকে সঠিক জায়গায় পৌঁছাতে আমাদের সোচ্চার হতে হবে, কৃষক সংগঠন ও রাজনৈতিক দলগুলোর নানাবিধ এজেন্ডাসহ প্রচুর উদ্যোগের মাধ্যমে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। অন্যথায় এ দেশের ভাগ্যাকাশে ভয়াবহ দুর্দিন অপেক্ষা করছে।
আর এ উদ্যোগগুলো আমাদের জন্য অনেক কঠিন কিছুও না, বাংলা অঞ্চলের ইতিহাসই তার সাক্ষী। উপমহাদেশীয় ৭০০ বছরের মুসলিম সালতানাতের অভিজ্ঞতা ও নতুন বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে কৃষি হয়ে উঠুক মুক্তির অন্যতম হাতিয়ার।
– মুহসিনা বিনতি মুসলিম