শিউলিমালা একাডেমি

আল হামরা প্রাসাদ

আন্দালুসিয়ায় স্বর্ণালি, গৌরবময় মুসলিম শাসনামলের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে আধুনিক স্পেনের বুকে আজও দাঁড়িয়ে আছে গ্রানাডার ঐতিহাসিক আল হামরা প্রাসাদ।

আল হামরা আন্দালুসে মুসলিম শাসনের শেষ শতকের স্থাপত্যরীতি ও সংস্কৃতির অনন্য নিদর্শন। গ্রানাডার আমিরাত নামে পরিচিত পশ্চিম ইউরোপের সর্বশেষ স্বাধীন মুসলিম রাজ্য নাসিরিদ রাজ্যের শাসনামল (১২৩০-১৪৯২) থেকেই মূলত আল হামরার সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল সময়ের সূচনা হয়। এ সময়েই আল হামরাকে দুর্গ থেকে প্রাসাদে পরিণত করা হয়। তিনশো বছর ধরে বিভিন্ন পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের মাধ্যমে হৃদয়গ্রাহী সাজে সেজে উঠে এই প্রাসাদ।

গ্রানাডার পশ্চিমে সাবিক পাহাড়ের উপর চারপাশের ঘন সবুজ বনের মাঝে অবস্থিত দৃষ্টিনন্দন আল হামরা প্রাসাদ। প্রাসাদের বাঁ দিক দিয়ে বয়ে গেছে দারো নদী।

প্রাসাদের প্রতিটি ঘরকে আলো-আঁধারি, পর্যাপ্ত বাতাস, পানি, নির্জনতার এক সুষম ও শৈল্পিক মিলন মেলায় পরিপূর্ণ করে সাজানো হয়েছে। প্রাসাদের প্রতিটি অংশেই রয়েছে মার্বেল পাথরের অতি সূক্ষ্ম কাজের মাঝে ফুটে ওঠা আধো আলো-আঁধারির খেলা, বাইরে রয়েছে ফুল গাছ, ফোয়ারা, রৌদ্র-ছায়ায় আলপনা।

ইসলামী শিল্প ও স্থাপত্যের জার্মান-সুইস বিশেষজ্ঞ টাইটাস বার্কার্ড বলেছেন, “জলই আল হামরার রহস্যময় জীবন গড়ে তুলেছে। এ জলই এখানকার উদ্যানগুলোকে অবিরাম সবুজ করে তোলে, ঝোপঝাড় এবং গুল্মগুলো ভরে উঠে রাশি রাশি ফুলে। পুলগুলোর স্থির জলে সুন্দর মার্বেলের হলগুলোর প্রতিবিম্ব প্রতিফলিত হয়ে অনন্য সৌন্দর্যের জন্ম দেয়। ফোয়ারা থেকে প্রতিনিয়ত বেরিয়ে আসা জলরাশির মৃদু গুঞ্জন প্রতি মূহূর্তে প্রতিধ্বনিত হয়ে পৌঁছে যায় প্রাসাদের কেন্দ্রে, ঠিক যেমন কোরআনে জান্নাতের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।”

আল হামরার দৈর্ঘ্য ২৪৩০ ফুট এবং প্রস্থ গড়ে ৬০০ ফুট। প্রায় ১৫ লাখ ৩০ হাজার বর্গফুট এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এ প্রাসাদ উত্তর-পশ্চিম থেকে দক্ষিণ-পূর্বে প্রলম্বিত। ১৭৩০ মিটার দেয়াল ঘেরা শহরের ভেতরে রয়েছে ত্রিশটি টাওয়ার আর চারটি সদর দরজা। আল হামরার মূলত তিনটি অংশ– রাজকীয় সেনাবাহিনীর বাসস্থান বা আল কাজাবা, শাসকের পরিবারের প্রাসাদ এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য উদ্যান শোভিত শহর বা মদিনা।

প্রাসাদের পশ্চিম দিক দুর্গ আকৃতির, এটিই আল কাজাবা। চারদিকে উঁচু দেয়ালের ভেতরে তিনটি বুরুজ বা টাওয়ার এখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উঁচু টাওয়ারটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। আরো রয়েছে তেরোটি মিনার। আল হামরা প্রাসাদকে ছোট-বড় তিনটি মুরিশ প্রাসাদের সমন্বয়ে একটি কমপ্লেক্স হিসেবে বিবেচনা করা যায়। প্রত্যেকটি প্রাসাদ আবার অনেকগুলো স্থাপনা এবং খোলামেলা উঠোনের সমন্বয়। সবচেয়ে বেশি নজর কাড়ে প্যালাসিওস নাজারেস বা নাসিরিদ প্রাসাদ।

আল-হামরার প্রাসাদগুলোর স্থাপত্যশৈলী খুবই জটিল ও সৌন্দর্যমন্ডিত। অসংখ্য কলাম, ঝর্ণা, তোরণ, স্বচ্ছ পুকুর এর স্থাপত্যশৈলীকে আরো নান্দনিক ও জটিল করেছে। প্রাসাদগুলোর বাইরের দিকটা অবশ্য সাদামাটা। প্রাসাদের ভেতরের দেয়ালগুলোতে রয়েছে নানা রকম জটিল জ্যামিতিক কারুকাজ এবং অ্যারাবেস্কের কাজ। আরো রয়েছে মুসলিম বিশ্বে ব্যবহৃত আলকাটাডো টাইলসের কাজ, গাণিতিক নকশা ল্যাসেরিয়ার কাজ, স্টাকো এবং ফোলিয়েট অর্নামেন্টসের কাজ। কাঠের তৈরি গম্বুজাকার সিলিং সাজানো হয়েছে মাকার্নাসের নকশা দিয়ে। অভ্যন্তরীণ সজ্জার এ নান্দনিকতা মূলত গ্রানাডার আন্দালুসিয় শিল্পের অবদান। মুরিশ শিল্পীরা এ শিল্প আবিষ্কারের উপাদান সংগ্রহ করেছেন বাইজেন্টাইন ও সমকালীন আব্বাসীয় খেলাফত থেকে।

প্রাসাদের অভ্যন্তরের দেয়াল এবং বিভিন্ন অবকাঠামোর ক্যালিগ্রাফিতে আরবি অক্ষরে কী লেখা রয়েছে তার অধিকাংশই জানা সম্ভব হয়নি। তবে আধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে নিবিড় পরীক্ষণের মাধ্যমে জানা গেছে, এতে রয়েছে পবিত্র কোরআনের অসংখ্য আয়াত। এছাড়াও রয়েছে প্রাচীন আমলের অসংখ্য ক্ষুদ্র কবিতা। মুরিশ কবি ইবন জামরাকের কবিতাও খোদাই করা হয়েছে। রয়েছে নাসিরিদ গোত্রের পতাকা ও কোট অব আর্মস এ খচিত বিখ্যাত বাণী ولا غالب إلا الله, যার অর্থ ‘আল্লাহ ছাড়া আর কোনো বিজয় দানকারী নেই’।

অন্ধকারে নিমজ্জিত ইউরোপে জ্ঞান ও সভ্যতার আলোকধারায় উদ্ভাসিত মুসলিম শাসিত আন্দালুসিয়ার অন্যতম নিদর্শন এ আল হামরা। শুধু ইসলামী সভ্যতার বিখ্যাত শিল্পকর্ম, কারুকার্য বা স্থাপত্যশৈলীই নয়, আধ্যাত্মিকতারও এক নিদারুণ চিহ্নরূপে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকা আল হামরা যেন সময়ের ঘূর্ণাবর্তে হারিয়ে যাওয়া আন্দালুসিয়াকে ফিরে ফিরে ডাকে…

সংকলক: কাজী সালমা বিনতে সলিম

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *