আমি কি একটু বেশিই উচ্চাভিলাষী?
জানি না!
‘উচ্চাভিলাষী’ বলছি, কারণ আমি যে ‘কনজার্ভেটিভ মুসলিম বাঙ্গালী পরিবার’ এর মেয়ে!
এ পরিবার, এ পরিবেশ নানাবিধ কঠোরতায় আবৃত। নিজের ছোটখাটো ইচ্ছেগুলোর কথা প্রকাশ করতেও এখানে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়! নানা রকম কৌশল, ছলচাতুরিসহ সোজা বাংলায় বললে যাবতীয় দুই নম্বর পন্থা অবলম্বন করে একটু করুণার দৃষ্টিতে পড়লেই হয়তো তার কিছুটা আদায় করা সম্ভব হয়! নিতান্ত মানবিক চাওয়া-পাওয়াগুলো পূরণ করতে গেলেও এখানে রীতিমতো মানসিক হেনস্থার শিকার হতে হয়! মানবিক চাওয়া-পাওয়া মানে যে শুধুই ‘ভাত-কাপড়’, তা নয় অবশ্যই!
এখানে বিশ্বাস করা হয়, মেয়েদের স্বাধীন ব্যক্তিসত্তা থাকা অপরাধ! এখানে মেয়েদের পরিচয় হলো তারা ভয়াবহ রকমের ‘ফিতনা’! ‘মেয়েদের ব্রেইন কম’ নামক স্লোগানটা তো রীতিমতো তত্ত্বীয় ব্যাখ্যার দাবী রাখে এখানে, যা সর্বময় একটি মানসিক ব্যাধিতে পরিনত হয়েছে। গৃহের কাজ করা, বিয়ে করে সন্তান জন্ম দেওয়া এবং প্রতিপালন করা– শুধুমাত্র এসবকেই তাদের মৌলিক দায়িত্ব বলে বিশ্বাস করা হয়; এর বাইরের দায়িত্বগুলোর মৌলিকত্ব বিবেচনা করা দূরে থাকুক, এগুলোকে পুরোপুরি অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়া হয়!
আর অবশ্য প্রচলিত এ ধারণার বাইরে গিয়ে ভিন্ন আঙ্গিকে কিছু চিন্তা করলেই ‘নারীবাদী’, ‘প্রগতিবাদী’সহ নানান মুখরোচক ফতোয়া এ মহলের বুদ্ধিজীবীদের পবিত্র জবান থেকে তীরের বেগে ছুটে আসে!
তো এমনই একটা পরিবেশ থেকে যখন নিজের অবস্থান, স্বপ্নের পরিধি, চিন্তার সামগ্রিকতার কথা ভাবি, তখন যারপরনাই হোঁচট খাই।
যখন উদাস চিত্তে তাকিয়ে স্রষ্টা প্রদত্ত আমানতের কথা ভাবি; যখন পৃথিবীতে বিদ্যমান হাজারো ভারসাম্যহীনতা, বিশৃঙ্খলা আর জুলুমগুলো পরিলক্ষিত হয়; যখন ভাবি রাস্তায় পড়ে থাকা শিশুটার জন্য চিরস্থায়ীভাবে কিছু করা দরকার, জীবিকার তাগিদে মান-সম্ভ্রম বিক্রি করে দেওয়া দেশে থাকা পাঁচ লক্ষ মা-বোনদেরকে অর্থনৈতিক পণ্যে পরিনত হতে না দিয়ে মানুষ হিসেবে মর্যাদা দেওয়া দরকার, হিন্দুত্ববাদী সস্তা সংস্কৃতির বিপরীতে মানব প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ সুষ্ঠু সংস্কৃতির বয়ান হাজির করে যুবসমাজের জীবন প্রকৃত অর্থে অর্থবহ করে তোলা দরকার; তখন নিজের সমগ্র অস্তিত্বকে প্রশ্ন করতে বাধ্য হই, “ওহে মুক্তিকামী! তুমি কি দুনিয়া বিনির্মানের জন্য প্রস্তত?”
একটা পরিচ্ছন্ন বসবাসযোগ্য দুনিয়ার জন্য সমগ্র মানবতা আজ চাতক পাখির ন্যায় প্রতীক্ষিত, তাই আমি আমার দায়িত্বহীনতার কথা স্মরণ করে পীড়িত হই, নিজেকে গঠন করার শারীরিক-মানসিক প্রস্তুতি নিই, কিন্তু ঠিক তখনই এ মহলের পুরোহিত শ্রেণি আমার চোখে আঙ্গুল দিয়ে আমাকে বুঝিয়ে দেয়, “তুমি ‘মেয়ে’! নামাজ পড়ো, পর্দা করো, রোজা রাখো, স্বামীর আনুগত্য করো, সন্তানের দেখাশোনা করো; দুনিয়ার জীবনে শুধুমাত্র এগুলোই তোমার দায়িত্ব। এ দায়িত্বগুলো ঠিকমতো পালন করলেই তোমার জন্য জান্নাত সুনিশ্চিত, এর বেশি কিছু করার প্রয়োজন নেই!”
তুমি ‘মেয়ে’!
কী অসাধারণ একটা পরিভাষা!
অপারগতার প্রতীকস্বরূপ ব্যবহৃত একটা পরিভাষা!
বুদ্ধিবৃত্তিক হীনমন্যতাকে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকিয়ে দিতে এই পরিভাষাটাই যথেষ্ট। আর এই হীনমন্যতাকে মাড়িয়ে আপন সত্ত্বাকে চেনা আত্মবিশ্বাসী আমি/আমরা আজ বড় শোচনীয় পরিস্থিতিতে!
অথচ আমরা মহান হাকীমের এই সুশোভিত দুনিয়ার সকল রঙ ‘স্বপ্ন’ হিসেবে তুলে দিতে চেয়েছি মুক্তিকামী জনতার চোখের তারায়, সৃষ্টিকুলের সকল হিকমতের চাদর একত্রে উন্মোচিত করে এক-একটি দায়িত্বের মালা ঝুলিয়ে নিতে চেয়েছি নিজ নিজ কন্ঠে। আমরা চাই এক নতুন দুয়ারের পাদদেশে দাঁড়িয়ে ঘুমন্ত মানবতার কর্ণকুহরে মুক্তির সুর তোলার সাধ জাগিয়ে তুলতে…
আমি বিশ্বাস করি, হৃদয়ের মণিকোঠায় ঈমানের আদলে গড়া স্বপ্নকে কেন্দ্র করে ইস্তেকামাত আর আত্মবিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে এই সাধ বাস্তবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব…
আমার এই চাওয়া কি উচ্চাভিলাষের পর্যায়ে পড়ে?
হোক তবে উচ্চাভিলাষ-ই!
তাই আমি আত্মবিশ্বাসী।
– নাজিফা আঞ্জুম