বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন এবং সুপরিচিত একটি স্থাপত্য নিদর্শন আতিয়া মসজিদ। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক মুদ্রিত পুরনো দশ টাকার নোটে ছবিযুক্ত থাকা এ মসজিদের অবস্থান টাঙ্গাইল জেলার দেলদুয়ার উপজেলার আতিয়া গ্রামে; লৌহজং নদীর পূর্বপারে। টাঙ্গাইল অঞ্চলে প্রাপ্ত মূল শিলালিপিগুলোর মধ্যে আতিয়া জামে মসজিদে পাওয়া একটি আরবি ও একটি ফারসি শিলালিপি রয়েছে। এগুলোর মাধ্যমে মসজিদের নির্মাতা, সময়কাল ও প্রচলিত কিছু অসঙ্গতিমূলক তথ্য সমস্যার সমাধান করা যায় । বিদায়ী সুলতানি আর নবাগত মোগল- উভয় রীতির সংমিশ্রণে অপূর্ব এক মুসলিম স্থাপত্য এটি, যা দৃষ্টিনন্দন এবং এ অঞ্চলে বিরল। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে রক্ষিত শিলালিপি অনুসারে প্রত্মতাত্ত্বিক আতিয়া মসজিদটির নির্মাণকাল ১০১৯ হিজরি (১৬১০-১১ খ্রি.) উল্লেখ আছে। সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময়ে বায়েজীদ খান পন্নীর পুত্র সাইদ খান পন্নী, শাহ বাবা কাশ্মীরির সম্মানার্থে মসজিদটি নির্মাণ করেন বলে জানা যায়। আদি শিলালিপির অনুরূপ একটি লিপি বর্তমানে কেন্দ্রীয় প্রবেশ পথের শীর্ষে প্রোথিত আছে। এ থেকে জানা যায় যে, ১০১৮ হিজরিতে (১৬০৯ সাল) মসজিদটি নির্মিত। মসজিদটির নামকরণে এক ঐতিহাসিক তাৎপর্য রয়েছে। আরবি শব্দ ‘আতা’ থেকে ‘আতিয়া’ শব্দের উৎপত্তি; যার অর্থ – দানকৃত’।
১৫৯৮ সালে আলি শাহান শাহ্ বাবা আদম কাশ্মিরী (র.) কে সুলতান আলাউদ্দিন হুসাইন শাহ টাঙ্গাইল জেলার জায়গিরদার নিয়োগ করেন। তিনি এই অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করেন এবং ইসলাম ধর্ম প্রচার ও আন্যান্য ব্যয় নির্বাহের জন্য আফগান নিবাসী কররানী শাসক সোলাইমান কররানীর কাছ থেকে সংলগ্ন এলাকা দান বা ওয়াকফ্ হিসাবে লাভ করেন। এই এলাকাটি তাঁকে দান করায় এই অঞ্চলটির নাম হয়েছে ‘আতিয়া’ বা দানকৃত। পরবর্তীতে বাবা আদম কাশ্মিরীর পরামর্শে সুফিজির এক ভক্ত সাঈদ খান পন্নীকে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর এই আতিয়া পরগণার শাসন কর্তা হিসেবে নিয়োগ দান করেন। এই সাঈদ খান পন্নীই ১৬০৯ মতান্তরে ১৬০৮ সালে বাবা আদম কাশ্মিরীর কবরের সন্নিকটে আতিয়া মসজিদ নির্মাণ করেন। মুহাম্মদ খাঁ নামক তৎকালীন এক প্রখ্যাত স্থপতি এই মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা ও নির্মাণ কাজে যুক্ত ছিলেন।
মসজিদটির দৈর্ঘ্য ১৮.২৯ মিটার (৬৯ ফুট) , প্রস্থ ১২.১৯ মিটার (৪০ ফুট) এবং দেয়ালের পুরুত্ব ২.২৩মিটার (সাড়ে ৭ ফুট)। বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন সূত্রে জানা যায়, মসজিদটির কিবলাকোটা ও বারান্দাসহ সার্বিক পরিমাণ ১৭.৭০ঃ১২ মিটার। মসজিদের দেয়াল ২.২২ মিটার প্রশস্ত। বারান্দা ৩.৮২ ৭.৫ মিটার।
লাল ইটের তৈরি এ মসজিদটির পূর্ব দিকে তিনটি প্রবেশ পথ রয়েছে। এ প্রবেশ পথগুলো চতুর্কেন্দ্রিক রীতির। বারান্দা থেকে তিনটি প্রবেশপথের মাধ্যমে প্রধান ইবাদত কক্ষে প্রবেশ করা যায়। এছাড়াও এটির উত্তর-দক্ষিণে আরও দুটি প্রবেশপথ রয়েছে। মসজিদটি একই সাথে সুলতানি ও মোগল আমল এ উভয় আমলের স্থাপত্যকলা তথা মুসলিম স্থাপত্য রুচিকে সুস্পষ্টভাবে বহন করছে। সুলতানি আমলের নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে মিহরাব, কিবলা। দক্ষিণ এশীয়দের জন্য কিবলা পশ্চিমে করা হয়েছে। একই সময়ের অন্যতম বৈশিষ্ট্য দেখতে পাওয়া যায় মসজিদের খিলানসমূহে। আতিয়া মসজিদের খিলানগুলো চতুর্কেন্দ্রিক অথাৎ উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম- চারটি দিক দিয়েই ইবাদত কক্ষে প্রবেশ করা যায়। কিবলার দেয়ালে তিনটি অলঙ্কিত মিহরাব রয়েছে। কেন্দ্রীয় মিহরাবের পেছনে বাইরের দেয়াল কিছুটা প্রক্ষেপিত। মসজিদের চার কোণে চারটি অষ্টভুজাকৃতির পার্শ্ব বুরুজ রয়েছে যা সমান দূরত্বে মোল্ডিং নকশায় বিভক্ত। কয়েকটি স্তরে তৈরি করা কারুকার্য দিয়ে সজ্জিত পার্শ্ব বুরুজগুলো ছাদের কার্নিশের উপর পর্যন্ত উঠে গেছে। সব শেষের বুরুজগুলো পলকাটা ছোট গম্বুজযুক্ত এবং কলস ফিনিয়ালে অলঙ্কৃত।
প্রধান গম্বুজটি খিলানভিত্তিক স্কুইঞ্চ পদ্ধতিতে নির্মিত। মনোমুগ্ধকর এ প্রধান গম্বুজটি মসজিদের অত্যন্ত নান্দনিক অংশ যা মসজিদের বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে প্রকাশ করে। এটি অষ্টভুজাকৃতির ড্রামের উপর স্থাপিত। গম্বুজগুলোতে কলস ফিনিয়াল এবং ভিতের চারদিকে বদ্ধ মারলোন নকশা বেষ্টিত। আতিয়া মসজিদের ধনুকবক্রাকৃতির কার্নিশ একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। এ মসজিদের পশ্চিম দেয়ালের শীর্ষে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সংবলিত প্রহরা দেয়াল (battlemented wall) লক্ষ্য করা যায়।
আতিয়া মসজিদের পূর্ব ও উত্তর দেয়াল যে অলঙ্করণ নকশা করা হয়েছে তা এ মসজিদ প্রসঙ্গ মাত্রই উল্লেখের দাবি রাখে। এতে টেরাকোটা ও ইট খোদাই নকশাতে চমৎকারভাবে আঞ্চলিক মোটিফকে উপজীব্য করে অলঙ্কৃত করা হয়েছে। সম্পূর্ণ ফাসাদ সূক্ষ্ম, বিস্তৃত একই রকম প্যানেল নকশায় আচ্ছাদিত। এতে রয়েছে অসংখ্য ফুলের অলঙ্করণ, চক্রাকার ‘রোজেট’, জ্যামিতিক নকশা ইত্যাদি। পূর্ব ফাসাদ অসংখ্য ক্ষুদ্র আয়তাকৃতির টেরাকোটা প্যানেল নকশায় দৃষ্টিনন্দন হয়ে উঠেছে। এ জাতীয় নির্মাণ কৌশল ষোলো শতকের প্রথম দিকে গৌড়ের বিভিন্ন মসজিদে লক্ষ্য করা যায়। যেমন: ঝনঝনিয়া মসজিদ (১৫৩৫ খ্রি.), কদম রসুল ইমদরত (১৫৩০ খ্রি.)।
আতিয়া মসজিদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি কুঁড়েঘরের কার্নিশের ন্যায় ধনুকের মতো বাঁকা আকৃতির কার্নিশ যা সম্পূর্ণভাবে বাংলার আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে। এ ধরনের আকৃতির উৎপত্তিতে আদি অকৃত্রিম বাংলার ছনের কুটিরের বাঁকানো চালের প্রভাব স্পষ্ট । অলঙ্করণ বিশেষ করে টেরাকোটা নকশা ও খোদাই ইটের নকশায় বাংলার ওস্তাগর-শিল্পীরা সুস্পষ্ট অবদান রেখেছেন। বাংলার গ্রামের খড়ের তৈরী কুঁড়ে ঘরের বেড়ার খোপ নকশা আতিয়া মসজিদের ফাসাদ অলঙ্করণে স্থান করে নিয়েছে। বস্তুত বাঁশের চালাঘর থেকে ইটের নির্মাণে এ ধরনের উদ্ভাবন শিল্পমানে আকর্ষণীয় এবং নির্মাণ ক্ষেত্রে নতুন ধারা হিসেবে বিবেচিত।
মসজিদটি টেরাকোটার ইটের তৈরি। চুন, সুরকি গাঁথুনি দিয়ে মসজিদটি নির্মিত। আর সুলতানি আমলে প্লাস্টার পদ্ধতি ছিল না। ফলে তারা চুন ও সুরকির গাঁথুনি দিয়ে মসজিদটি নির্মাণ করেন। এছাড়া সুচালো খিলান ও গম্বুজ সবই সুলতানি আমলের নিদর্শন। আতিয়া মসজিদের পূর্ব ও উত্তর দিকের বাইরের দেয়ালে টেরাকোটার ওপর চমৎকার বৃত্তের মাঝে ফুলের নকশা করা, যেটি মোগল আমলের স্থাপত্যরীতির নিদর্শনকে বহন করে। মসজিদটি সুলতানি ও মোগল আমলের বৈশিষ্ট্যে সমন্বিত বলে এটি যুগসন্ধিক্ষণের স্থাপনা হিসেবেও পরিচিত।
এক গম্বুজবিশিষ্ট বর্গাকৃতির মসজিদটির পূর্বদিকে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র তিন গম্বুজবিশিষ্ট আয়তাকৃতির বারান্দা রয়েছে। পূর্বদিকে খিলানবিশিষ্ট তিনটি প্রবেশপথ, মাঝখানেরটি দুপাশের প্রবেশপথ থেকে সামান্য উঁচু। অসংখ্য নকশাখচিত মসজিদটির গায়ে খোদাই করা হয়েছে আরবি হরফ। মসজিদের বারান্দার ওপর ছোট তিনটি গম্বুজ বাংলা পান্দান্তিভ পদ্ধতিতে নির্মিত। পরে সংস্কারের সময় গম্বুজগুলো পলেস্তারা দিয়ে সমান করে দেওয়া হয়েছে যদিও মসজিদ নির্মাণের সময় এমনটা ছিল না। শুরুতে গম্বুজগুলো পলকাটা বা ঢেউতোলা ছিল।
১৮০০ সালে সংঘটিত ভূমিকম্পে আতিয়া মসজিদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। পরবর্তীতে ১৮৩৭ সালে রওশন খাতুন চৌধুরাণী এবং ১৯০৯ সালে আবুল আহমেদ খান গজনবী মসজিদটির সংস্কার করেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকার এই মসজিদটিকে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে অধিগ্রহণ করেন।
১৯৭৮ সালে ১০ টাকার নোটের প্রচ্ছদে প্রথমবারের মতো আতিয়া মসজিদ স্থান পায় বলে জানা যায়। এরপর ১৯৮২ সালে পরিবর্তিত ১০ টাকার নোটের প্রচ্ছদেও স্থান পায় সেটি। ফলে, প্রায় সব বাংলাদেশীর কাছে আতিয়া মসজিদ একটি অতিপরিচিত স্থাপনা। মসজিদটি শুধু ঐতিহ্যের নিদর্শনই নয়, একটি দর্শনীয় স্থানও বটে।
৪০০ বছরের পুরোনো এ মসজিদ বাংলাদেশ এবং সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম স্থাপত্যরীতির ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্মারক হয়ে আছে। সময়ের বহমান স্রোতে ভেসে আজও মুসল্লিরা প্রাচীন এই মসজিদে একত্রিত হয়ে এক আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করে।
সংকলক: মিমি বিনতে ওয়ালিদ